কাতার সঙ্কট ও আলজাজিরার পথপরিক্রমা by মো: বজলুর রশীদ

কাতারের সাথে যে ক’টি আরব দেশ ৫ জুন ২০১৭ সম্পর্ক ছিন্ন করে তারা সাথে সাথে আলজাজিরার নিউজ চ্যানেল এবং অফিসও বন্ধ করে দেয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কাতারের চেয়ে আলজাজিরা নিউজ চ্যানেলই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বা শত্রু! কাতার ব্লকেডের পর আলজাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্কের সব সিস্টেম, ওয়েবসাইট ও সামাজিক মিডিয়া প্লাটফর্মে সাইবার হামলা চালানো হয়েছে। তবে সম্প্র্রচার মাধ্যমের কর্মকর্তারা হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন। সাইবার হামলার প্রাথমিক রিপোর্ট পাওয়ার পরপরই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশের দর্শকেরা চ্যানেলটি দেখতে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন। আলজাজিরা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেল। এই চ্যানেল নিয়ে কাতারের সাথে দীর্ঘ দিন ধরে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরোধ চলছে। তারা এই চ্যানেলের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে সমস্যা উসকে দেয়ার অভিযোগ আনছে। ২০০৩ সালেই আলজাজিরার ওয়েবসাইট হ্যাক করে অজ্ঞাতনামা হ্যাকাররা। আলজাজিরার ওয়েবসাইটে ঢুকলেই লোকজন দেখত আমেরিকার পতাকা উড়ছে। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আলে সানি বলেন, সৌদি নেতৃত্বাধীন ব্লকভুক্ত জাতিগুলো কাতারের ওপর কেন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেÑ সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। তবে এটা কি মূলত আলজাজিরার জন্য ভবিষ্যতে হয়তো এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে।
আরবিতে জাজিরা মানে দ্বীপ। সে থেকে আলজাজিরা নেটওয়ার্কের নামকরণ। এর সদর দফতর কাতারের দোহায়। রাষ্ট্র এই স্যাটেলাইট চ্যানেলের খরচ বহন করে। কাতার সরকার এর মূল মালিক। থানি পরিবার আংশিক খরচ বহন করে এবং তাদের মালিকানাও রয়েছে। আলজাজিরা প্রথমে আরবি নিউজ চ্যানেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এখন বিভিন্ন ভাষায় বিশ্বব্যাপী সম্প্রচার করে থাকে। আলজাজিরার সম্পাদকেরা সংবাদ সম্পাদনায় স্বাধীনতা ভোগ করেন। ১৯৯৬ সালের ১ নভেম্বর, বিবিসির আরবি ভাষার সম্প্রচার বন্ধ হলে আলজাজিরার পথচলা শুরু হয়।
আলজাজিরার বিশ্বব্যাপী ৮০টি ব্যুরো অফিস রয়েছে। আফগান যুদ্ধের সময় সেখান থেকে লাইভ সম্প্রচার করে বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়িয়ে আনে। আলজাজিরার যাত্রা শুরুর এক বছরের মধ্যে কর্মী সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০০। এখন তিন হাজারেরও অধিক। ১ জানুয়ারি ১৯৯৯ আলজাজিরা ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচার শুরু করে। তখন বাজেট ছিল ২৫ মিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বে খুবই প্রভাবশালী নিউজ এজেন্সিতে পরিণত হয়। আরব দর্শকরা আলজাজিরার ভক্ত হয়ে পড়ে। ১৭ বছর আগে জরিপে দেখা যায় তখন আলজাজিরার দর্শক ছিল ৩৫ মিলিয়ন, যা আরব বিশ্বের সেরা চ্যানেলে পরিণত করে। আলজাজিরা সৌদি সহায়তাপুষ্ট এমবিসি বা গরফফষব ঊধংঃ ইৎড়ধফপধংঃরহম ঈবহঃৎব ও লন্ডনভিত্তিক অৎধন ঘবংি ঘবঃড়িৎশকে ছাড়িয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে ৭০টি আরবি ভাষায় সম্প্রচারিত স্যাটেলাইট চ্যানেল থাকলেও এখন আলজাজিরাই সেরা। আলজাজিরা এপ্রিল ২০০৪ সালে বিশ্বের সেরা পাঁচ নিউজ ওয়েবসাইটের জন্য ডবননু অধিৎফং লাভ করে। অন্য চারটি হলো, বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, রকেট নিউজ ও দ্য স্মোকিং গান।
আরব বিশ্ব বিবিসি ও সিএনএন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যায় যখন তারা দেখে যে, তাদের বিষয়ে সঠিক বিষয় উপস্থাপন করা হয়নি বা বিষয়টিকে টুইস্ট করা হয়েছে। আর অনেক বিষয় আছে যা প্রচারই করা হয় না। যেমন ফিলিস্তিন, গাজা, রোহিঙ্গা, মরো, কাশ্মির, লেবানন এসব বিষয়ে কচিৎ কোনো খবর পাওয়া যায়। আফ্রিকার দেশগুলোর রিপোর্টিংও উল্লেখ করার মতো। যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থ আছে সেসব বিষয়ে রিপোর্ট করা হয়। আরব বিশ্বের এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, পশ্চিমা মাধ্যমের ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং ঘটনার সঠিক বিশ্লেষণ করতে আলজাজিরা প্রকাশ। এখন বলতে গেলে আলজাজিরা বিশ্বের সেরা নিউজ নেটওয়ার্ক।
আলজাজিরার সম্প্রচার বড় বড় নিউজ চ্যানেল ও পশ্চিমাদের বিপক্ষে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ঐঁময গরষবং এই বিষয়ে একটি বই লিখেন যার নাম অষ ঔধুববৎধ : ঞযব ওহংরফব ঝঃড়ৎু ড়ভ ঃযব অৎধন ঘবংি ঈযধহহবষ ঞযধঃ ওং ঈযধষষবহমরহম ঃযব ডবংঃ. আলজাজিরার পথপরিক্রমায় মধ্যপ্রাচ্যে শুধু আরবসেট স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল। ওই সময় ঈধহধষ ঋৎধহপব ওহঃবৎহধঃরড়হধষ আরব দর্শকদের জন্য বিশেষ করে সৌদি আরবের দর্শকদের জন্য ৩০ মিনিটের পর্নোগ্রাফি প্রচার করত। এমন এক সময়ে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ট সংবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে আলজাজিরা কাজ শুরু করে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর একচোখা নীতির বিপরীতে আলজাজিরার সাহসী সংবাদ এ সময় জনপ্রিয়তা পায়। আলজাজিরাই মধ্যপ্রাচ্য বা এশিয়ার প্রথম কোনো টিভি চ্যানেল, যা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈকিতভাবে স্বাধীন মত প্রচারের জন্য একমাত্র আলজাজিরাকে বিবেকবান মনে করা হয়। বলা হয় যে, ইসরাইলি-প্যালেস্টানি শান্তিচুক্তির রূপরেখা ফিলিস্তিনিরা কিভাবে গ্রহণ করবে সে ব্যাপারে মত প্রকাশকে আলজাজিরা প্রভাবিত করে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো বা পরিচালিত করার মতো ক্ষমতা ও দক্ষতাও আলজাজিরার রয়েছে। ফিলিস্তিনিরা বলতে গেলে ৬০ ভাগ আলজাজিরানির্ভর। প্যালেস্টাইন টিভি ও আল আরাবিয়া মাত্র ১০ শতাংশ দর্শক। তাই প্যালেস্টইনের রাজনীতিতে আলজাজিরা ‘মুভার ও শেকারের’ কাজ করছে।
ইরাক আক্রমণ কাভারেজের জন্য ও এ বিষয়ে ‘কন্ট্রোল রুম’ ডকুমেন্ট তৈরির জন্য আলজাজিরা ২০০৪ সালে পুরস্কার লাভ করে। ২০০৮ সালে মিসরের বিপ্লবের ওপর ‘মিসরে ২০১১ জনবিপ্লব’ প্রচার করে। ২০১৫ সালে ‘আইএসআইএল’ ও তালেবান নামে শক্তিশালী ডকুমেন্ট প্রচার করে। সম্প্রতি ঞযব ঈৎঁংধফবং-অহ অৎধন চবৎংঢ়বপঃরাব নামে চার পর্বের কালজয়ী ডকুমেন্ট তৈরি করেছে। জাপান থেকে আমেরিকা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ের ওপর আলজাজিরা ডকুমেন্ট প্রচার করে, যা তাদের নিজেদের তৈরি ও কিছু বিভিন্ন মিডিয়া থেকে ক্রয় করা। এসব ডকুমেন্টের মান উন্নত হওয়ায় আলজাজিরা বৈশ্বিক শ্রোতা-দর্শক পেয়েছে। আলজাজিরার ইন্টারভিউগুলো এবং ফুটেজগুলো আমেরিকা, ব্রিটিশ ও অন্যান্য নিউজ মিডিয়ায় পুনঃপ্রচারিত হয়। সিএনএন ও বিবিসিতেও প্রচারিত হয়। ২০০৩ সালে বিবিসি আলজাজিরার সাথে তথ্য ও ফুটেজ বিনিময়ের জন্য চুক্তি করে।
আলজাজিরা লাদেনের প্রেরিত ভিডিও টেপ প্রচার করে বিশ্বে সাড়া জাগায়। ওসামা তখন ওয়ান্টেট ছিল। তখন সমালোচনা করা হয় যে আলজাজিরা ‘সন্ত্রাসীর’ বক্তব্য প্রচার করছে। এরপর টনি ব্লেয়ার আলজাজিরার টক শোতে অংশ নেয়। আফগান যুদ্ধের সময় আলজাজিরা সবার দৃষ্টি কাড়ে। কেননা আলজাজিরা কাবুলে যুদ্ধের আগ থেকেই অবস্থান করছিল এবং ফুটেজ ও সংবাদ সংগ্রহ করে ভিডিও ফুটেজ তৈরি করছিল। আলজাজিরার একটি ভিডিও ফুটেজের দাম ২৫০,০০০ ডলার পর্যন্ত ওঠে। এতে সহজেই প্রমাণিত হয় যে, কত মূল্যবান ভিডিও ফুটেজ তারা তৈরি করেছিল। গুরুত্বপূর্ণ সঠিক তথ্য প্রবাহের ফলে বুশ প্রশাসন ক্ষেপে যায় এবং আলজাজিরার কাজকর্ম বন্ধ করার জন্য কাবুল অফিসে ২০০১ সালে বোমা বর্ষণ করে। বুশ বলে বেড়ায় যে, প্রয়োজন হলে মূল কেন্দ্র ধ্বংস করে দেয়া হবে। বুশের এ কথা থেকে বোঝা যায় যে, আলজাজিরা কত শক্তি লাভ করেছিল। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের কভারেজের কারণে আলজাজিরা বৈশ্বিক দর্শকের নজর কাড়ে এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করে। আলজাজিরা তখন ১৪০০ কর্মী, ৭০ জন বিদেশ প্রতিনিধি এবং ৪৫০ জন সাংবাদিক কাজ করেছিল। ইরাকে অপারেশন ডেজার্ট ফক্সের ১৯৯৮ সালে বোমা বর্ষণের সময় আলজাজিরাই ছিল একমাত্র নিউজ নেটওয়ার্ক। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো আলজাজিরায় প্রচারিত ভিডিও ক্লিপগুলোর ভূয়সী প্রশংসা করে।
সমালোচকরা বলেন, আলজাজিরার উদ্দেশ্য হলো, পশ্চিমা বিশ্ব, আরব দেশ ও আরব সংস্কৃতি নিয়ে যা রিপোর্ট করে তাকে কাউন্টার করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেকে অভিযোগ করেন যে, আলজাজিরা কাতারের প্রপাগান্ডা প্রচারদ্বার। ইসলামের জাগরণ এবং ব্রাদারহুডপন্থী। আঞ্চলিক ইস্যুতে সুন্নিপন্থী ও শিয়াবিরোধী পথ অবলম্বন করে। বাস্তবে আলজাজিরা ইরানি তথ্য এবং সব পক্ষের মতামত সব সময় তুলে ধরে এমনকি আরব স্রোতাদের জন্য ইহুদিদের মতামতও প্রচার করে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ যুদ্ধ, ইসরাইলি বাহিনীর আগ্রাসন, মিসরে ব্রাদারহুডের ওপর সিসি সরকারের দমন-পীড়ন তুলে ধরাসহ আরব বসন্তের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে চ্যানেলটি। আরব বিশ্বে গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতে গিয়েই আরব শাসকদের অপছন্দের তালিকায় পড়ে আলজাজিরা। মিসরে মোবারকের আমলে গণরোষকে আলজাজিরা উসকে দেয় বলে সিসি অভিযোগ করেছে। তার মতে, আলজাজিরার কারণে মিসরে মুরসির বা ব্রাদারহুডের উত্থান হয়েছে। মিসর সে থেকে আলজাজিরার সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করে। তিনজনকে গ্রেফতার করে এবং একজন এখনো জেলহাজতে দিন কাটাচ্ছে। এসব কারণে সৌদি ব্লকেডের সাথে মিসরও সমর্থন জানায়।
আরব বসন্তের সময় আলজাজিরারই এক রাজধানীতে থেকে আরেক রাজধানীতে ঢেউ লাগানোর কাজ করে মর্মে নিউ ইয়র্ক টাইমস ২০১১ সালের জানুয়ারিতে মতপ্রকাশ করে। তিউনিসিয়া ও মিসরের বিপ্লবকে এগিয়ে নিতে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। জজ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কলিংক বলেন, ‘তারা প্রত্যক্ষ কোনো কাজে অংশ নেয়নি, কিন্তু আলজাজিরা ছাড়া এসব হয়েছে তা কল্পনাও করা যায় না।’
আলজাজিরার সম্প্রচার আরব দর্শকের মন মানসিকতাকে প্রভাবিত করতে থাকে। কথা বলার স্বাধীনতা ও সত্য ঘটনার স্বাদ পেতে থাকে এবং সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা করতে থাকে। আলজাজিরা আরব দেশগুলোয় সরকার ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রচার করতে থাকে। বাস্তবতা ও রাজনীতির মধ্যে যে বিস্তর ফারাক রয়েছে তা তুলে ধরতে থাকে। বিশেষ করে সৌদি আরব, বাহরাইন, সিরিয়া ও লেবাননের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর এবং বিরোধীয় বিষয়ের ওপর বক্তব্য সম্প্রচার করতে থাকে। এসব বক্তব্য, ঘটনা ও ইন্টারভিউ সম্প্রচারের কারণে কোনো কোনো সময় আরব দেশগুলোতে এক দিনের মাথায় প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হতো। এর তালিকা অনেক দীর্ঘ।
আলজাজিরা আরবি চ্যানেলে জনপ্রিয় প্রভাব বিস্তারকারী ‘আল শারিয়া ওয়া আলহায়া’ বা শরিয়ত ও জীবনযাপন বিশেষ শো প্রচার করে যার দশর্ক সংখ্যা ৬০ মিলিয়ন। ইউসুফ আল কারজাভিকে আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে সেখানে দেখানো হয়। অনুষ্ঠানটি বারবার দেখানো হয় ও সমালোচনাও চলতে থাকে। শোতে তিনি বলেছেন, ‘ইহুদিদের আল্লাহ শাস্তি দিবেন তাদের দুর্নীতির জন্য। হিটলারের মাধ্যমে তাদের শেষবার সাজা দেয়া হয়েছে।’ তিনি ধ্বংসের জন্য নয় শত্রুদের ভীতি প্রদর্শনের জন্য মুসলমানদের পরমাণু শক্তির অধিকারী হওয়াকে বৈধতা দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ২০ বছর ধরে তিনি নিয়মিত ‘শরিয় অ্যান্ড লাইফ’ নামক প্রশ্নোত্তরপর্ব অনুষ্ঠানটিতে জবাব দিয়েছেন লাখ লাখ দর্শক-শ্রোতার বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব। ধর্ম, পারিবারিক সমস্যা, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে ইসলামি শরিয়তের বিধানসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার কাছে প্রশ্ন করতেন বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা। অনুষ্ঠানটিতে কারজাভির বিভিন্ন স্পষ্ট বক্তব্য তাকে ইউরোপ, আমেরিকাসহ আবর বিশ্বের অনেকে দেশের শাসকদের কাছেও তাকে শত্রুতে পরিণত করে। ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলনে সমর্থন দেয়ার কারণে তাকে নিষিদ্ধ করে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। মিসরের ব্রাদারহুডের সাথে তার সম্পৃক্ততা ও ইসলামপন্থী সব আন্দোলনের প্রতি সমর্থনের কারণে মিসরসহ আরব বিশ্বের অনেক দেশই তার বিরোধী। গত সপ্তাহে সৌদি আরব বিশিষ্ট ইসলামি ব্যক্তিত্ব কারজাভিকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে। কুয়েতের সাথে উপসাগরীয় দেশগুলোর সাম্প্রতিক সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে আরব শাসকেরা আলজাজিরাকে ধ্বংসের একটি উপলক্ষ যেন খুঁজে পেয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ইসরাইল মূলত সিরিয়া সমস্যাসহ আরব বিশ্বের ঘটনাবলিকে এত জটিল করার জন্য দায়ী। সবকিছু যেন ইসরাইল নিয়ন্ত্রণ করছে। বিদ্রোহী গ্রুপ তৈরি করা থেকে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ সব কিছুই করছে। এসব কাজে মিডিয়া মোঘল হিসেবে হেইম সাবানকে ব্যবহার করছে। মিসরে জন্মগ্রহণকারী এক আমেরিকান-ইসরাইলি। মধ্যপ্রাচ্য সমস্যাকে উসকে দেয়ার জন্য তিনটি পথ নির্দেশনা দিয়েছে। (১) রাজনৈতিক দলগুলো, বিদ্রোহী ও সিরিয়ার ওহাবি সংগঠনকে তহবিল সরবরাহ করা; (২) থিংক ট্যাংক বসানো, যেমন ওয়াশিংটন ও দোহায় হেইম সাবান কেন্দ্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান বসানো, এটা খুবই অবাক করার ব্যাপার যে, ইহুদি গ্রুপগুলো উপসাগরীয় দেশগুলোতে কাজ করে যাচ্ছে। (৩) মিডিয়া-সম্প্রচারকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ। সঠিক সংবাদ যেন পরিবেশিত না হয়, যেন বিভ্রান্তকর বা মিথ্যা সংবাদ ছড়ানো যায়। যার উদাহরণ আমরা হৌলা ধ্বংসযজ্ঞে দেখেছি। হেইম সাবানের অফিস কাতারের দোহায়ও গোপনে কাজ করছে। এসব কাজে ইহুদি এজেন্টারা রাত দিন ব্যস্ত।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু আলজাজিরা ও স্থানীয় অফিস বন্ধ করার উপায় খুঁজছেন। জর্ডান ও সৌদি আরব আলজাজিরার স্থানীয় অফিস বন্ধ করে দিয়েছে, চ্যালেলও বন্ধ করে দিয়েছে। আমিরাত, মিসর ও বাহরাইনও বন্ধ করে দিয়েছে। ইসরাইল দীর্ঘ দিন ধরে বলে আসছে আলজাজিরা তাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালায়। ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এভিগডর লিবারম্যান বলেন, আলজাজিরার প্রচার ‘নাজি জার্মানি স্টাইল’ প্রপাগান্ডা। ইসরাইলি পত্রিকায় সংবাদ বের হয়েছে যে, নেতানিয়াহু নেতাদের নিয়ে আলজাজিরা বন্ধ করার বিষয়ে গোপন সভা করেছেন; কিন্তু সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে নেতানিয়াহুর অফিস কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করে। তারা স্থানীয় অফিসও বন্ধ করেনি। অথচ আলজাজিরাই একমাত্র চ্যানেল যেখানে ইহুদিরা হিবরু ভাষায় কথা বলেন এবং আরব জনগণকে কিছু বলার থাকলে আলজাজিরার মাধ্যমেই বলেন। এখানেও আলজাজিরার নিরপেক্ষ-স্বাধীন প্রচারনীতি দেখা যায়। কাতারের সাথে বিরোধের জের ধরে টুইটার আলজাজিরার অ্যাকাউন্ট ইতোমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে।
অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও জনকণ্ঠ প্রকাশে আলজাজিরা বিশ্বকে নতুন পথ দেখিয়েছে। বৈশ্বিক তথ্যপ্রবাহের ভারসাম্যহীনতাকে প্রতিহত করেছে। চলমান সঙ্ঘাত নিরসনে কোনো বৈঠক হলে আলজাজিরা ইস্যুতে কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে কাতার। মনে করা হচ্ছে আলোচনায় এই গণমাধ্যমটিও উঠে আসবে এবং সংস্কারের জন্য চাপ দেয়া হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব, বাংলাদেশ সরকার ও গ্রন্থকার

No comments

Powered by Blogger.