অগ্নিগর্ভ কাশ্মীর by এ জি নুরানি

সম্প্রতি ইউনিফর্ম পরিহিত মেয়েরা একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল থেকে বের হয়ে হাতে যা কিছু পেয়েছে, তা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে পুলিশ ভ্যান লক্ষ করে ছুড়ে মেরেছে। শ্রীনগরের ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র লালচক এলাকায় এই দৃশ্য দেখা গেছে। কাশ্মিরের সাধারণ মানুষ বন্দুকের গুলির ভয়ভীতি উপেক্ষা করে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসছে। তারা পুলিশভ্যানে হামলা চালাচ্ছে; পুলিশ দেখলেই টিটকারি দিচ্ছে এবং ‘আজাদী’ বলে স্লোগান দিচ্ছে।
আগে কখনো এ ধরনের ঘটনা দেখা যায়নি। সাংবাদিক তৌফিক রশীদ এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে মন্তব্য করেছেন, ‘এই কিশোরী বালিকারা তাদের সমবয়সী ছেলেদের মতোই মৃত্যুকে পরোয়া না করে পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছে’। তিনি আরো বলেন, তাদের প্রচণ্ড ক্রোধ বা বেপরোয়াভাব ও সাহস শুভ লক্ষণ নয়।
এই সঙ্কটের সমাধান না করা পর্যন্ত কাশ্মিরে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতে থাকবে এবং তার প্রতিচ্ছবি ও প্রতিক্রিয়া চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে।
বিদ্রোহ বা বিপ্লবের জন্য বড় বা তুচ্ছ যেকোনো ঘটনাই যথেষ্ট। ১৯৮৯-৯০ সালের উত্থান অবস্থার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সত্য কথা বললে বলতে হয়, এ ধরনের ঘটনা ঘটার প্রকৃত কারণ হচ্ছে- কাশ্মিরের জনগণ কখনো চায় না যে, ভারত তাদের শাসন করুক।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে একজন প্রত্যক্ষদর্শী শ্রীনগর থেকে পপুলার মুড-এ লেখেন, ‘তারা বলে একমাত্র শেখ সাহেবই (আবদুল্লাহ) গণভোটে জয়লাভ করার ব্যাপারে আস্থাশীল।’ ওই প্রত্যক্ষদর্শী হলেন ইন্দিরা গান্ধী- যিনি তার পিতা প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি অর্থনৈতিক সংস্কার বা অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো হলে সব ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হয়ে যাবে। কারণ প্রকৃতপক্ষে মানুষ একটিমাত্র বিষয়ে উদ্বিগ্ন। সেটা হলো, তারা তাদের পণ্য বিক্রি করে খাদ্য এবং লবণ সংগ্রহ করতে চায়। তাদের কোনো আত্মা নেই।’
কাশ্মিরের ব্যাপারে নয়াদিল্লি কী বলে?
৭০ বছর পর এখনো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিকাশ (উন্নয়ন)-এর ব্যবস্থাপত্র বা নির্দেশ দিচ্ছেন। এতে সুবিধা হচ্ছে, বিদ্রোহী জনতা যে স্বাধীনতার দাবিতে ফুঁসে উঠেছে, সেই বাস্তব অবস্থাকে চাপা দিয়ে রাখা যায়। পাকিস্তান সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের প্ররোচিত করছে- বলে অভিযোগ এনে সচেতনভাবে নিজেরা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে প্রকৃত পরিস্থিতিকে ধামাচাপা বা আড়াল করে রাখা যাবে না। এই কিশোরী স্কুল ছাত্রীরাও অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তারাও অন্যদের মতো মৃত্যুকে পরোয়া করছে না। তারা সন্ত্রাসী নয়; তারা মুক্তিযোদ্ধা। তারা মাতৃভূমির স্বাধীনতা চায়।
ভারত কাশ্মিরিদের স্বাধীনতার দাবিকে কিছুতেই স্বীকৃতি দিতে চায় না। তারা চায়, কাশ্মির ভারতের অধীনে থাকুক। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর নির্যাতন, হত্যা, গুম ও বর্বরতা সত্ত্বেও কাশ্মিরি স্বাধীনতাকামীরা দমে যায়নি। তারা কাশ্মিরের আজাদীর জন্য হাসিমুখে প্রাণ দিতে প্রস্তুত। পাকিস্তান এ ব্যাপারে বারবার আলোচনা ও আপসরফার চেষ্টা করলেও মোদি সরকার পাকিস্তান এবং কাশ্মিরি স্বাধীনতাকামী, উভয়ের সাথে আপসরফার বিরোধী। সরকার সেনাবাহিনী দিয়ে জনগণের এই বিপ্লবের মূলোৎপাটন করতে চায়। কাশ্মিরের পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (পিডিপি) সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মির উপত্যকায় দমনাভিযান চালাতে আরো উৎসাহিত হয়েছে। বিজেপির সিনিয়র মন্ত্রী চন্দ্রপ্রকাশ গুপ্ত গত মাসে শ্রীনগরে বলেন, ‘লাটুন কি বহুত বাতুন সো নেহি মানথি; ইনকা ইল্জ জ্যোতি হ্যায়।’ তিনি বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই বক্তব্যের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, তারা পাকিস্তান থেকে আসুক অথবা এখানে বসবাস করুক- যেটাই হোক না কেন, তারা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক। বুলেটই হচ্ছে তাদের জন্য একমাত্র সমাধান। চাপের মুখে দুঃখ প্রকাশ করে বিজিপির সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে আড়াল করা যাবে না। গত মাসে ২৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে ভোটের দিন সেনাবাহিনীর জিপের সামনে বেঁধে রেখে ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিক্ষোভকারীরা যাতে প্রতিবাদ জানাতে না পারে, সে জন্য নির্যাতনের এই অভিনব পদ্ধতি বেছে নেয়া হয়। এর পক্ষে সাফাই গেয়ে তারা বলেছে- কাশ্মিরের জনগণের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় সব কিছু করা যায়। বিজেপি সাধারণ সম্পাদক নিজেদের বর্বরতার পক্ষে এ কথা বলেছেন।
কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি কাশ্মিরে দমন অভিযান চালানোর পরিবর্তে স্বাধীনতাকামীদের সাথে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার কথা বললে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাকে তিরস্কার করেন।
শ্রীনগরের একটি সরকারের কাশ্মিরিদের অধিকার নিয়ে নয়াদিল্লির সাথে আলাপ-আলোচনা করার কোনো অভিন্ন ভিত্তি নেই। বিজেপির সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করায় পিডিপি এমনিতেই ব্যাপক আলোচনা ও চাপের মুখে আছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সংলাপ বা আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নেয়াটা অর্থহীন।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯৪৮ সালে মনে করেছিলেন, কাশ্মিরের জনগণকে অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে খুশি করা যাবে। এখনো সেই ধরনের চিন্তাভাবনা ও আকাশকুসুম কল্পনার মধ্যে মোদি সরকার হাবুডুবু খাচ্ছে। কাশ্মিরি জনগণ ভারতীয় শাসন প্রত্যাখ্যান করেছে- এই বাস্তবতা মেনে নেয়া না হলে জনগণকে খুশি করার কোনো পদক্ষেপ বা আলাপ-আলোচনা কাজে আসবে না।
ভারত সরকার ২৮ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টে সরাসরি ঘোষণা দিয়েছে ‘তারা হুররিয়ত নেতাদের সাথে ‘আজাদীর’ ব্যাপারে কোনো আলোচনাই করবে না। তারা চূড়ান্তভাবে এই কথা জানিয়ে দিয়েছে। তাদের সুস্পষ্ট কথা হলো, আলাপ-আলোচনা অবশ্যই ভারতীয় সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে হতে হবে।
শ্রীনগর থেকে লোকসভার উপনির্বাচনে ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আবদুল্লাহ জয়লাভ করেছেন। তবে ১৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীরা সক্রিয় ছিল। সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি সত্ত্বেও স্বাধীনতাকামীরা সেখানে অত্যন্ত তৎপর ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
মোদি সরকার মনে করছে, তারা বর্বরোচিত নির্যাতনের মাধ্যমে কাশ্মিরিদের আজাদী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে সক্ষম হবে এবং কাশ্মিরের পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ‘উন্নতি’র দিকে যাবে। আর এভাবে সেনাবাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করা গেলে বলবে, কাশ্মির সঙ্কটের সমাধান হয়ে গেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এ ধরনের বর্বরতা ও নৃশংসতার পরিণতি কখনো শুভ হয় না। এই অপকৌশল কখনো সফল হয় না। ভারত ১৯৪৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একই ধরনের শঠতা, প্রবঞ্চনা ও বর্বর কৌশল প্রয়োগ করে এলেও সফলতার মুখ দেখেনি। ‘তারা সৃষ্টি করেছে নির্জনতা এবং সেটাকে শান্তি বলে আখ্যা দিয়েছে।’
লেখক : গ্রন্থ প্রণেতা এবং মুম্বাইভিত্তিক আইনজীবী
দৈনিক ডন থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

No comments

Powered by Blogger.