গোলাপের রাজ্য শ্যামপুর

শ্যামপুর গ্রামের প্রায় ষাট পাকি [১৫.৬০ শতাংশ] জমির ওপর বর্তমানে গোলাপ চাষ হয়ে আসছে। গোলাপ ফুল চাষ এখন শুধু এই গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বিরুলীয়া ইউনিয়নের অন্যান্য গ্রামেও প্রসারিত হয়েছে। বছরের বারোমাসই গোলাপ চাষ হয়ে থাকে। ভর সন্ধ্যায় ফুল বিক্রির বাজার মিলে ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার বিরুলীয়া ইউনিয়নের উত্তর শ্যামপুর গ্রামের পথে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা গাড়ি হাঁকাই। চালকের আসনে আমি নিজেই। চিপা গলি পেরিয়ে মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহনকে ছাড়িয়ে আমি যাই এগিয়ে। মনে শুধু ভয় একটাই চাকা না হয় পাংচার। এ বিষয়টাকে আমি মহা ভয় পাই। গাড়ি চলছে- সাভার বাজার পেছনে ফেলে, মহাসড়ক থেকে ডানে মোড় নিয়ে সিঅ্যান্ডবি সড়কে ছুটছি। এবার সরু পথে ফিটনেসবিহীন গাড়ি থেকেও মহাভয়ঙ্কর অটোরিকশার জ্বালায় কিছুটা ভীতু আমি। যদি গাড়িতে আঁচড় লাগে তাহলে তো আব্বার ধমকি কত প্রকার তা আরেকবার জানা হয়ে যাবে। আক্রাইনের মোড় থেকে শুরু হল আরও বেদনাবিধূর রাস্তা, এসেই যখন পড়েছি তখন আর কী করা। দেশের বড় বড় নাম করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখানে অথচ সড়কের কী বেহাল দশা! একেই বলে বাতির নিচে অন্ধকার। তবে দে-ছুটের বন্ধুরা ঠিকই অন্ধকারের বিপরীতে আলোর ঝলক খুঁজে নিতে পারে। এবারও তাই হল। ভাঙা সড়কে দোল খেতে খেতে কিছুটা পথ আগাতেই নৈসর্গিক সব দৃশ্যে চোখ আটকাল। সত্যিই অসাধারণ, ঢাকার পাশেই এমন মায়াবী প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না। সোঁদা মাটির গন্ধ নাকে পেতে পেতেই চোখে ধরা পরল লাল গোলাপের বিশাল বাগান। গাড়ি পার্ক করেই ছুটি বাগানের ভেতর। ইয়া খোদা! এই দেখি বিশাল লাল গোলাপের সমুদ্র তার মাঝে আমরা অতিকায় এক ক্ষুদ্র প্রাণী। যতই এগিয়ে যাই ততই যেন অপার্থিব ভালোলাগা ভর করে মনে। বাগানের পর বাগান। মাথায় নেশা চেপে বসে, কিসের গাড়ি আর কিসের বাড়ি। সবই আজ ঠুনকো।
গাড়ির চিন্তা বাদ দিয়েই ভেতর থেকে ভেতরে ঢুকতে থাকি। যতই এগোতে থাকি ততই যেন গোলাপ বাগানের লোকগুলো আপন হতে থাকে। প্রথম বাগানে যে আঁটির দাম ছিল ৪০০ টাকা এখন তা পারলে এমনিতেই দিয়ে দেয়। আগে থেকেই ধারণা পেয়েছিলাম বিরুলীয়া এলাকার লোকজন একটু উগ্র, যার কারণে সাভারবাসীই তাদের টুঙ্গুইরা বলে থাকেন কিন্তু আমরা পেয়েছি তার উল্টো। কথায় আছে না, নিজে ভালোতো জগৎ ভালো। হাঁটতে হাঁটতে এবার পেয়ে যাই এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সব গাছকে ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে থাকা তাল গাছের সারি। জসিমের চোখে ধরা পড়ে রসের হাঁড়ি। হানিফ বলে রস খাবে। দুঃখের বিষয় তালের রসের স্বাদ পেতে হলে আবারও আসতে হবে সাতসকালে। কি আর করা এক সফরে তো আর সব মিলে না। ওরকম আশা করাটাও ঠিক নয়। গাছির সেল নাম্বার নিয়ে আবারও এগোই। এবার চোখ পড়ে ঝাকায় ঝুলে থাকা লাউ আর মাটিতে শুয়ে থাকা মিষ্টি কুমড়ার প্রতি। দেখা হয় স্থানীয় বাসিন্দা বয়োবৃদ্ধ আবদুল খালেকের সঙ্গে। তিনি জানালেন এই টেঙ্গর শ্যামপুর গ্রাম থেকেই গত বিশ বছর আগে প্রথম গোলাপ চাষ শুরু করেন গোলাম রসুল। তার বাগান করা দেখেই ধীরে ধীরে গ্রামের অন্যরাও অনুপ্রাণিত হয়ে ফুল চাষে এগিয়ে আসেন। শ্যামপুর গ্রামের প্রায় ষাট পাকি [১৫.৬০ শতাংশ] জমির ওপর বর্তমানে গোলাপ চাষ হয়ে আসছে। গোলাপ ফুল চাষ এখন শুধু এই গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বিরুলীয়া ইউনিয়নের অন্যান্য গ্রামেও প্রসারিত হয়েছে। বছরের বারোমাসই গোলাপ চাষ হয়ে থাকে। ভর সন্ধ্যায় ফুল বিক্রির বাজার মিলে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা আসেন গোলাপ কিনতে। দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের জন্য ফুলচাষীরা গড়ে তুলেছেন নিরাপত্তাবলয়। মাগরিবের নামাজ শেষে সবুজের বারোভাজা খেয়ে ফিরতি পথ ধরি। ইচ্ছে হলে একটা বিকাল কাটিয়ে আসতে পারেন পুরো পরিবার কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে।
যোগাযোগ : ঢাকা থেকে উত্তরা থার্ড ফেস, মিরপুর বেড়িবাঁধ ও গাবতলী হয়ে সাভার উপজেলার বিরুলীয়া ইউনিয়নের উত্তর শ্যামপুর গ্রামে সরাসরি নিজস্ব/ভাড়া গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। এছাড়া সাভার বাজার স্ট্যান্ড থেকে বাসে বা লেগুনাতে যাওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে কয়েকবার যানবাহন বদল করতে হবে। আর উত্তরা বা বেড়িবাঁধ দিয়েও নিজস্ব গাড়ি ছাড়া যেতে চাইলে কয়েক দফা গাড়ি বদল করে বিরুলীয়া ব্রিজ দিয়ে চলে যেতে পারেন।
খাবেন কোথায় : আক্রাইন/দোসাইদ বাজারে মোটামুটি মানের রেস্টুরেন্ট পাবেন আর বিকালের নাস্তার জন্য দোসাইদ বাজারে রাবিয়া খালার বানানো হরেক পদের ভর্তা দিয়ে চিতই, ভাপা আর মালপোয়া পিঠা খাবেন তার ডেরার দোকানে। সঙ্গে থাকবে গরুর দুধের চা।

No comments

Powered by Blogger.