এনবিআরের ষড়যন্ত্র সরকারের বিরুদ্ধে

নির্বাচনী বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর কালো ভ্যাট আইনের খক্ষ নামিয়ে দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও ভোটারদের ক্ষুব্ধ করে তুলতে গলাকাটা এ আইন বাস্তবায়ন করতে ১ জুলাই থেকে মাঠে নামতে যাচ্ছে সংস্থাটি। অথচ বাস্তবতা হল এ আইন কার্যকর হলে গ্যাস-বিদ্যুতের মতো সর্বজনীন উপকরণসহ সব পণ্যেই জনগণকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। এতে সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষ নতুন এ চাপ সহ্য করতে পারবেন না। আর নির্ঘাত এর বিরূপ প্রভাব পড়বে আগামী জাতীয় নির্বাচনে। ক্ষতিগ্রস্তদের ভোটবঞ্চিত হবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সোমবার এমন সব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান ব্যবসায়ী নেতাসহ সাধারণ ভোক্তাদের অনেকে। এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে সরকার রাজনৈতিকভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা সরকারের নির্বাচনের বছরে আইএমএফসহ বিদেশি দোসরদের খুশি করতে প্রকারান্তরে সরকারের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে এনবিআর। এটি শুধু অভিযোগ নয়, এর বাস্তব যুক্তিও আছে। এফবিসিসিআই সভাপতি মাতলুব আহমাদ যুগান্তরকে বলেন, পণ্য ও সেবার বিক্রয় মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার ফলে জনগণ কষ্টকর অবস্থার মধ্যে পড়বেন। এতে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এর ফলে জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, লাওস এমনকি পার্শ^বর্তী দেশ ভারতেও রাজ্যভিত্তিক ভ্যাট হার আছে। বাংলাদেশকেও সে পদ্ধতি অনুসরণ করে মাল্টিপল ভ্যাট হার রাখা উচিত। এতে কিছুটা হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। নতুন আইন বাস্তবায়ন হলে ট্যারিফ মূল্য, সংকুচিত ভিত্তিমূল্য উঠে যাবে। বর্তমানে ইট, রড, গুঁড়া দুধ, হাতে তৈরি বিস্কুট, চশমার ফ্রেম, জেনারেটরসহ ৮৫টি পণ্য ট্যারিফ মূল্যের সুবিধা ভোগ করছে। আর সংকুচিত ভিত্তিমূল্যের আওতায় বিদ্যুতে ৫ শতাংশ, পরিবহন খাতে ১০ শতাংশ, মোটরগাড়ির গ্যারেজে ১০ শতাংশ, আসবাবপত্রে ৪ শতাংশ, ভবন হস্তান্তরে দেড় শতাংশ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ ভ্যাট আছে। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হলে এর বদলে সব পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। একাধিক ব্যবসায়ী নেতা যুগান্তরকে বলেন, মানুষের আয় বাড়েনি। কেননা সামগ্রিক অর্থে বিনিয়োগ না বাড়লে আয় বাড়ে না। আর বিনিয়োগের বেহাল অবস্থা তো সবার জানা। কিন্তু সরকার বড় বাজেট দিতে গিয়ে মহল বিশেষের ফাঁদে পা দিয়েছে। এখন বেশি পরিমাণে রাজস্ব আদায়ে গলাকাটা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাস্তবায়নের পর মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও সমহারে বেড়ে যাবে। তারা বলেন, তাদের এ যুক্তি যদি সত্য বলে বিবেচিত হয় তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে এনবিআর যে ষড়যন্ত্রে নেমেছে সেটিও সত্য। তারা মনে করেন, শুধু সংখ্যাতত্ত্বের বড় বাজেটের ফাঁদে পা দিলে তা সরকারের জন্য বুমেরাং হবে।
এদিকে ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইনের কবলে পড়ে শুধু সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে না, হুমকিতে পড়বে দেশীয় শিল্প। ১ হাজার ৩৭০টি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক উঠে যাওয়ার কারণে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা হারাবে। তখন আমদানি পণ্যে সয়লাব হয়ে যাবে দেশের বাজার। চীন থেকে আমদানি করা নিন্মমানের পণ্যের কাছে দেশীয় পণ্য মার খাবে। পণ্য উৎপাদনের চেয়ে আমদানিতে উৎসাহিত হবেন ব্যবসায়ীরা। এতে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হবে। বেকারত্ব বাড়বে। অন্যদিকে সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ফলে খক্ষ নামবে ভোক্তার ওপর। বেশি অর্থ দিয়ে পণ্য ও সেবা কিনতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি আশঙ্কাজনক হারে বাড়বে। সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। কারণ নতুন আইনে সংবেদনশীল খাত যেমন- স্টিল, জুয়েলারি, গ্যাস-বিদ্যুতের ওপরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। তারা মনে করেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হলে শিল্পপতি থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ দোকানি পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে সব পর্যায়ের ভোক্তাসাধারণ বিপাকে পড়ে যাবেন। কেননা যিনি বিক্রি করবেন তার হয়তো প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতি হবে না, কারণ তিনি তো ভ্যাট কালেক্টর। কিন্তু যার কাছে বিক্রি করবেন তাকে ১৫% টাকা বেশি গুনতে হবে। তাদের মতে, বিদ্যমান ভ্যাট আইন দিয়েই সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু বেশির ভাগ রাজস্ব কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে সরকার তা ঘরে তুলতে পারছে না। তাই আগে দুর্নীতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু শাস্তি না হওয়ায় প্রশাসনসহ সমাজের সর্বস্তরে আজ দুর্নীতি জেঁকে বসেছে।
দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা উঠে যাবে : নতুন ভ্যাট আইনের দ্বিতীয় তফসিল অনুযায়ী, সিগারেট, মদ-বিয়ার, গাড়িসহ বিলাসবহুল পণ্য ছাড়া বেশির ভাগ পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। ট্যারিফ সিডিউলের দেড় হাজার পণ্যের মধ্যে মাত্র ১৭০টিতে সম্পূরক শুল্ক রাখা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৩৭০টি আইটেমের পণ্যের ওপর তা উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে প্লাস্টিক, পাদুকাসহ বেশির ভাগ শিল্পে ধস নামবে। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, নতুন ভ্যাট আইনের আওতায় আমদানি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক উঠে গেলে দেশীয় শিল্প মরে যাবে। সম্পূরক শুল্ক উঠিয়ে দিয়ে শিল্পকে কীভাবে সুরক্ষা দেয়া হবে তার কিছুই বলা হচ্ছে না। ইনসেনটিভ বা অন্য কোনো উপায় বের না করা পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখা উচিত। প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, সম্পূরক শুল্ক উঠে গেলে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ সম্পূরক শুল্কের আরোপ থাকায় বিদেশ থেকে প্লাস্টিক পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত হতো। এর ওপর ভিত্তি করে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে উদ্যোক্তারা। এই মুহূর্তে সম্পূরক শুল্ক উঠিয়ে দেয়া হলে শিল্পে ভয়াবহ বিপর্যয় নামবে। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) অজুহাত দেখিয়ে স্থানীয় শিল্পকে ধ্বংস করতে সম্পূরক শুল্ক উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বিভিন্নভাবে তাদের স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিচ্ছে। এন্টি-ডাম্পিং ডিউটি, কাউন্টারভেইলিং ডিউটির মতো নানা ধরনের অশুল্ক বাধার মেকানিজম রেখেছে। কিন্তু এ ধরনের মেকানিজম আমাদের নেই। স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষার মেকানিজম তৈরি না করে সম্পূরক শুল্ক উঠানো উচিত হবে না। ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের মহাসচিব আবু মোতালেব বলেন, নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল আসেনি। ব্যবসাবান্ধব করা ছাড়া আইন বাস্তবায়ন করা হলে তা ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা মেনে নেবে না। বাজেটের আগেই ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী আইন সংশোধন করতে হবে। তা না হলে এফবিসিসিআই’র নির্বাচনের পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরাম পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করবে।
ভোক্তার ওপর চাপ পড়বে : নতুন আইনে ১৫(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনে ভিন্নতর কিছু না থাকিলে, করযোগ্য সরবরাহ বা করযোগ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূসক (ভ্যাট) হার হইবে ১৫ (পনের) শতাংশ।’ অর্থাৎ কয়েকটি বাদে দেশের সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করবে সরকার। এ বিষয়ে ক্যাবের সভাপতি কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের মতো সর্বজনীন পণ্য ভ্যাটের আওতার বাইরে না রাখলে ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এ ধরনের পরিস্থিতি সাধারণ জনগণ সহজভাবে মেনে নেবে না। সরকারকে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার আগে ১০০ বার ভেবে দেখা উচিত। তিনি আরও বলেন, নতুন ভ্যাট আইন ভোক্তাবান্ধব না করে বাস্তবায়ন করলে ভোক্তাদের বাজেটে বাড়তি চাপ পড়বে। তাই ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে সংশোধন করা উচিত।
সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ও বাড়বে : নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাবে। প্রথমত, গ্যাস-বিদ্যুতের মতো জ্বালানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। দ্বিতীয়ত, বিপণন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এ দুই কারণে নির্মাণ সামগ্রীর মূল উপকরণ রডের দাম বাড়বে টনপ্রতি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। আর ইটের দাম বাড়বে হাজারে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। এ বিষয়ে অটো রি-রোলিং মিল অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক সুমন চৌধুরী বলেন, বর্তমানে প্রতি টন রড ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্য থেকে সরকারকে ৯০০ টাকা ভ্যাট দিতে হচ্ছে। নতুন আইন বাস্তবায়ন হলে প্রতি টন রডে ভ্যাট দিতে হবে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। রেয়াত বাদ দিলে ভ্যাট হবে ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি টন রডের দাম হবে ৫৫ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, শিল্পের বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিলে উৎপাদন খরচ বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে রডের দামে। বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির মহাসচিব আবু বকর বলেন, ট্যারিফ মূল্যের আওতায় বর্তমানে প্রতি হাজার ইটে ৪৫০ টাকা ভ্যাট দিচ্ছি। নতুন আইনে বিক্রয় মূল্যের ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ফলে ভ্যাট দিতে হবে ১ হাজার টাকার বেশি। এতে ইটের দাম বাড়বে। তিনি আরও বলেন, নতুন ভ্যাট আইন ইট ব্যবসায়ীদের মাঝে জটিলতার সৃষ্টি করছে। স্বল্প শিক্ষিত হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী ভ্যাটের হিসাবপত্র রাখতে এবং ইসিআর ব্যবহার করতে পারবে না।

No comments

Powered by Blogger.