এই রাজনীতির পরিণতি ভালো হতে পারে না

দিন কয়েক আগের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন কর্মচারী আমার রুমে এলেন। একটি ব্যাপারে আমার পরামর্শ চায়। একজনের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। এ নিয়ে সংকট তাদের। মেয়েটি গত বছর আইএ পাস করেছে। বিয়ের প্রস্তাব এসেছে পাশের উপজেলা থেকে। ছেলে বিএ পাস। ঠিকাদারি ব্যবসা করে। পারিবারিক অবস্থাও খারাপ না। আমি বললাম, সম্বন্ধ তো ভালোই মনে হচ্ছে, তাহলে সমস্যা কোথায়? মেয়ের বাবা মাথা চুলকে বললেন, ছেলে রাজনীতি করে। কিন্তু এতে অসুবিধা কী জানতে চাইলাম। ভদ্রলোক সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, রাজনীতি করা ছেলেরা কি ভালো হয় স্যার? আমার বাবা তো শুনেই বেঁকে বসেছেন। বাবা এককালে পোস্ট অফিসের কর্মচারী ছিলেন। সৎভাবে কষ্ট করে আমাদের বড় করেছেন। বলছেন, ভালো মানুষরা এখন রাজনীতি করে না। আমি চাই না আমার নাতজামাই সন্ত্রাসী আর দুর্নীতিবাজ হোক। তুমি অন্য জায়গায় পাত্র খোঁজ। আমি খুব বড় রকমের হোঁচট খাইনি। রাজনীতির বর্তমান হালচাল সচেতন মানুষের দৃষ্টি এড়ায় না। এ দেশের রাজনীতি আদর্শহীনতার কারণে এখন ক্ষয়িষ্ণু দশায় পৌঁছেছে। তাই রাজনীতির প্রতি ক্রমে আস্থা হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। রাজনীতিকরা মানুষের হৃদয়ের আসন থেকে অনেকটাই ছিটকে পড়ছেন। এ সত্যটি খুব দুর্ভাগ্যজনক।
আমাদের মনে হয় রাজনীতি থেকে দেশপ্রেমের ক্রমেই নির্বাসিত হওয়া রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির প্রধান কারণ। এখন ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা রাখা রাজনীতিকরা ‘রাজনৈতিক বক্তব্যে’র মোড়কে প্রতিদিন অসংখ্য মিথ্যাচার করেন, জেনেশুনে নানা বিষয়ের অপব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের অথবা দলীয় সুবিধার জন্য মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত করে তোলেন। আদিম মানুষ যখন পাথর যুগের অবসান ঘটিয়ে নগর সভ্যতার পত্তন করেছিল, তখন থেকে জন্ম হয়েছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার। রাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশের সঙ্গে রাজনীতিরও যাত্রা শুরু হয়। তাই রাজনীতির সঙ্গে বরাবরই দেশপ্রেমের সম্পর্ক ছিল। আবার রাজনীতির ভেতরে ‘অপরাজনীতি’ বা ‘ষড়যন্ত্রের রাজনীতি’রও জন্ম হয়েছিল শুরু থেকেই। ক্ষমতার লোভ যখন দেশাত্মবোধকে পরাজিত করে, তখন দেশের বক্ষ বিদীর্ণ করে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের মতো রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকায় এখন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি অনেকটা অকেজো হয়ে গেছে। এর বদলে আমাদের মতো দেশে গণতন্ত্রের পোশাকি রূপ ও নামাবরণে দলতন্ত্রে বিভক্ত হয়ে পড়েছে রাজনীতি। রাজনীতিতে বহুদলীয় বিষয় থাকবে; কিন্তু সেখানে দেশপ্রেম-বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীদের হাতে দেশের ভাগ্য অর্পিত হলে হতাশা ছাড়া থাকে কী? ভাবতে কষ্ট হয়, হাজার বছরের স্বাজাত্যবোধে বলীয়ান বাঙালি মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল, বাংলাদেশের মানুষেরই তো পরিচিত হওয়ার কথা আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই, রাজনীতির ক্ষেত্রে যে গৌরব সৃজিত হয়েছিল আমাদের পূর্বসূরি রাজনীতিকদের হাতে, তার এখন ক্ষয়িষ্ণু দশা। পাকিস্তান পর্ব থেকে যদি একটি খতিয়ান তৈরি করি তো দেখব বাম রাজনীতি একসময় জনপ্রিয় ছিল এর আদর্শিক সততা ও গণমানুষ-সম্পৃক্ততার কারণে। এখন সময় হয়তো নতুন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে।
রাজনীতিকদের অনেকের মধ্যে আদর্শচ্যুতি ঘটেছে। কমেছে গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্ক। জাতীয় রাজনীতিতে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না এ ধারার রাজনীতিকরা। তবে ক্ষমতার রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেননি বলে একেবারে বখে যাননি তারা। অন্যদিকে রাষ্ট্রক্ষমতা একমাত্র লক্ষ্য থাকায় বড় দলগুলোর একপক্ষ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গৌরবের ঐতিহ্যকে আরও উজ্জ্বল না করে তা ম্লান করে চলেছে, আর অন্যপক্ষ ঐতিহ্যের সঞ্চয় না থাকায় নানা মিথ্যাচার করে ও অপশক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ক্ষমতার বিজয়স্তম্ভে পৌঁছতে ছুটছে। তাই দেশের মানুষ ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্ন এসব রাজনীতিকের কাছে অবান্তর। এ ধারার বক্তব্যের পক্ষে তো উদাহরণের অভাব নেই। অতি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে দৃষ্টি বোলানো যেতে পারে। আমাদের প্রধান বিরোধী দল আর সরকারি দল তো বরাবর দুই মেরুতে অবস্থান করছে। সবাই মানেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেশের কল্যাণে উভয় দলের ঐকমত্যে পৌঁছানো উচিত। অন্তত নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমানো উচিত। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরলপথে পা মাড়াবেন না কেউ। কারণ উভয় দলের নেতানেত্রীদের মধ্যে যেন আতঙ্ক কাজ করে, একটু বরফ গলালে বা একটু নরম হলে রাষ্ট্রক্ষমতায় পৌঁছা বা ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। এ অবস্থা রাজনীতিকদের আত্মবিশ্বাসকে অনেক বেশি দুর্বল করে দেয়। ফলে তাদের ভেতর আত্মমর্যাদাবোধ আর সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার গণতন্ত্র চর্চা দুর্বল বলে জনগণের ওপর আস্থা রেখে নিজেদের শক্তিমান ভাবতে পারছেন না তারা। তাই ভোটের রাজনীতির কথা ভেবে বা রাজনৈতিক কৌশল বলে প্রচার করে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির আদর্শ ধারণ করা দল অবলীলায় কট্টর সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে হাত মেলাতে দ্বিধা করছে না। এসব কারণে জাতীয় নির্বাচনের হালকা সুর বাজতেই বিএনপি নেতারা পুরনো সুরে কথা বলছেন। তাদের পছন্দমতো নির্বাচনের আয়োজন না করলে নির্বাচন হতে না দেয়ার হুমকিও দিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে সরকারি দল গণমানুষের ভালো লাগা-মন্দ লাগাকে পরোয়া না করেই মৌলবাদী শক্তির কাছে মাথানত করছে। হেফাজতে ইসলামের মৌলবাদী দাবি একের পর এক মেনে ভোটের রাজনীতিতে জিততে চাইছে। যদিও কওমি মাদ্রাসা আর হেফাজত এক জিনিস নয়, তবুও হেফাজতকে খুশি রাখতে কৌশল আঁটছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এতে মাঝে মাঝে হাস্যকরও হয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। যেমন দিন দুই আগে কওমি মাদ্রাসার হুজুরদের একটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় নানা প্রশংসা করতে করতে কওমি মাদ্রাসাসংশ্লিষ্টদের একমাত্র খাঁটি মুসলমান হিসেবে সার্টিফিকেট দিলেন। রোমান পোপরাও একসময় টাকার বিনিময়ে পাপ মুক্তির সার্টিফিকেট বা ইনডালজেন্স বিক্রি করতেন। সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না, এর জন্য আত্মবিশ্লেষণ নেই, আছে লোক হাসানোর মতো আত্মম্ভরিতা। গণপরিবহনের নৈরাজ্য ঠেকাতে গিয়ে সরাসরি ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। বেপরোয়া ড্রাইভারদের আইনের আওতায় এনে শাসন করার ক্ষমতা সরকারের নেই। পরিবহন যানবাহনের মালিকদের বড় অংশই আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি। শ্রমিক ও মালিক ইউনিয়নও মোটের ওপর সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। তবুও সরকার প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাচ্ছে না। লাভ আর লোভের কাছে পরাস্ত হচ্ছে জনসেবার ধারণা। বাস্তব অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, সংঘশক্তির ভয় দেখিয়ে সরকারকে কাবু করে সুবিধা পেতে চাইছে কোনো কোনো শক্তি। ভোটের রাজনীতিতে মৌলবাদী শক্তিগুলো সবসময় সুবিধার ফসল ঘরে তুলতে চায়। যে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে একা দাঁড়ালে দু-একটি আসন পাওয়া নিয়ে সংকটে থাকে, তারাও ভোটব্যাংকের মূল্যায়নে বিএনপির পক্ষপুটে বসে যায়। ২০১৩-এর আগে যে হেফাজত নাম-পরিচয়হীন ছিল, সেই সংঘটি শাপলা চত্বরে বিপুল অনুসারী দেখিয়ে আতঙ্ক ধরিয়ে দিল ক্ষমতাপ্রিয় দলগুলোকে। সে সময় বিএনপি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল হেফাজতের দিকে। সতর্ক হয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। এ শক্তিটিকে বিএনপির দিকে ঘেঁষতে দেয়া যাবে না। যে কট্টর মৌলবাদী দল নারী নেতৃত্ব মানে না, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা নেই, তাদের আস্থায় রাখার জন্য দলীয় আদর্শ বিসর্জন দিয়ে কাছে টেনে নিল আওয়ামী লীগ। পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায়ও নিল না। প্রমাণ হল দাপট দেখাতে পারলেই সরকার নতজানু হবে। একইভাবে আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি নিজ দলের নেতৃত্বের দুর্বল জায়গার খোঁজ পেয়ে গেছেন। তাই প্রয়োজন পড়লেই অনুগত পরিবহন শ্রমিকদের পথে নামিয়ে সব অচল করে দিয়ে সরকারের সামনে নিজেদের দাপট দেখান। সরকারে নিজেদের প্রভাবকে নিশ্চিত করেন।
এসব দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত খুব অস্বস্তিতে আছেন। কোনো রকম জিম্মি দশায় থাকতে হচ্ছে না তো তাকে! তার মতো দৃঢ়চেতা আর গণতন্ত্রের প্রতি নিষ্ঠাবান নেত্রী কেমন করে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধবাদী একটি মৌলবাদী দলের সঙ্গে হাত মেলালেন? এমন নির্বাচনী কৌশল কি সুচিন্তিত? ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতকে কি বিশ্বাস করা যায়? অ্যাকশনের তো রিঅ্যাকশনও থাকে। আওয়ামী লীগের শুভানুধ্যায়ী অনেকে দলের এ আদর্শচ্যুতিতে ভোটের মাঠে নীরব হয়ে যাবেন কিনা তা কে বলতে পারে। এ সবের চেয়ে দেশজুড়ে দলে যে অভ্যন্তরীণ হানাহানি চলছে, তা কমিয়ে এনে দলকে শক্তিশালী করা কি অধিক লাভজনক হতো না? আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এসব দেখে বলছিলেন, আওয়ামী লীগ বোধহয় এবার পচা শামুকেই পা কাটল। এ সত্যটি সবাই মানবেন, দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চা থাকলে এসব সংকটকে সহজেই এড়ানো যেত। অপশক্তি জুজুর ভয় দেখিয়ে সুবিধা আদায় করতে পারত না। নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগ শক্ত অবস্থানে থাকার পরও এত দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ছে কেন? এতবড় দলের সাধারণ সম্পাদক যখন শুধু রাজধানীর গণপরিবহনের শৃঙ্খলা আনতে গিয়ে নিজ দলের মালিক-নেতাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন, তখন অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্যটিকে অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না। আমাদের ক্ষমতাপ্রিয় দলগুলোর পরিচালক-নীতিনির্ধারকরা বুঝতে চান না যে, মানুষ এখন অনেক সচেতন। জনস্বার্থবিরোধী তাদের সব কর্মকাণ্ড ক্রমে দলগুলোকে গণবিচ্ছিন্ন করে তুলছে। আইউব খানের সময় মুসলিম লীগ নিজেকে মহীরুহ মনে করেছিল। এ দলের অগস্ত্যযাত্রায় দুই যুগও লাগেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় দলগুলোর আত্মসমালোচনার সময় বয়ে যাচ্ছে। শুধু বর্তমান আগলে রেখে যদি নেতৃত্ব স্থূল সুখ ভোগ করতে চায়, তাহলে আলাদা কথা। মানতেই হবে স্বেচ্ছাতান্ত্রিক রাজনীতি যে কোনো দলের জন্য চরম পরিণতি ডেকে আনতে বাধ্য।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.