গণতন্ত্র: আদর্শহীন ব্যবস্থা?

গণতন্ত্র আদর্শ হিসেবে হোঁচট খেয়েছে আর ব্যবস্থা হিসেবে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মানছি যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় এ ভাবনাগুলোকে হালনাগাদ করে দিয়েছে। তবে ভারতে নরেন্দ্র মোদির বিজয় বা তুরস্কে এরদোয়ানের জুলাইয়ের ব্যর্থ অভ্যুত্থান-পরবর্তী কার্যকলাপ আগেই গণতন্ত্রকে কাঠগড়ায় তুলেছিল। গণতন্ত্রের বাঁধা বুলি পাকিস্তান আমল থেকেই শুনে এসেছি। সত্যিই পাকিস্তান শাসিত হয়েছে স্বৈরাচারী কায়দায়—কখনো সরাসরি সামরিক কর্তৃত্বে, কখনো বেসামরিক ছদ্মবেশে। গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানকে শেষ পর্যন্ত রণাঙ্গন অবধি টেনে আনতে হয়েছে সেই জগদ্দল ভাঙার জন্য। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা এনেছি—মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র ও অধিকারহীন পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশে বসবাস। পাকিস্তান আমল আর নেই, সেকালের চেয়ে অনেক ভালো আছি তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের চলমান গণতন্ত্রে আদর্শ গুরুত্ব হারিয়েছে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যথেষ্ট ঘাটতির মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্ন হলো, এর চেয়ে ভালো বিকল্প কি বর্তমান ব্যবস্থায় পাওয়া সম্ভব? যদি না হয়, তাহলে ব্যবস্থা পাল্টানোর প্রশ্ন উঠবে। সেই প্রশ্নটা মাথায় রেখে আমরা যে তিন নেতার কথা গোড়ায় বলেছি, তাঁদের প্রসঙ্গে একবার আসি। ট্রাম্প বিজয়ের জন্য আমেরিকাকে আবার মহান বানানোর যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন,
তাতে আফ্রিকান-আমেরিকান, হিস্পানিক জনগোষ্ঠী, এশীয় ও মুসলিম অভিবাসীদের প্রতিপক্ষ দাঁড় করিয়ে বস্তুত জনসংখ্যার ৭০ ভাগ শ্বেতাঙ্গ মার্কিনদেরই তাঁর পক্ষভুক্ত করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ অভিবাসীনির্ভর দেশটি যে ঐতিহ্যগতভাবে সব ধর্মবর্ণের মিলনপাত্র হয়েই মহান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে, তাকেই জবাব দিয়ে অর্থাৎ বিদায় করেই ট্রাম্পের মহান রাষ্ট্র তৈরি হবে! নরেন্দ্র মোদি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলেই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। এরদোয়ান তুরস্কের প্রশাসন ও জনজীবনে আধুনিক প্রগতিশীল অংশকে দুর্বল—সম্ভব হলে ধ্বংস—করে দেওয়ার জন্য ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সুযোগটাকে যেকোনোভাবে সর্বোচ্চ কাজে লাগাচ্ছেন। তাঁরা তিনজনই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন—ট্রাম্পকে যদিও আরও দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে ক্ষমতা ভোগ করার আগে। ট্রাম্প, মোদি, এরদোয়ান নির্বাচিত হয়েছেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, ভোটারদের রায়ে, কিন্তু সে রায় পক্ষে পেতে তাঁরা প্রচারণায় যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা কি গণতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ? বিষয়টা দাঁড়াল এই যে আদর্শের কোনো প্রয়োজন নেই, ব্যবস্থার ফায়দা যেভাবে আদায় করা যায়, সেভাবেই করো। ফলে প্রচারণায় রাজনৈতিক আদর্শের কথা মূল্যহীন; আক্রমণের বিষয় হতে পারে, ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায়। এতকাল এসব ছিল অজুহাতের মতো, কোনো ঘটনার প্রেক্ষাপটে আলোচিত বিষয়, যেমন টুইন টাওয়ারে হামলার জন্য কতিপয় সন্ত্রাসী দায়ী, যারা মুসলিম ও মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ। ট্রাম্প কথার মারপ্যাঁচে যাননি, সরাসরি প্রতিপক্ষ কারা চিনিয়ে দিয়েছেন। এরদোয়ানও প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে গিয়ে নিজের স্বরূপও খুলে ধরেছেন। মোদি অত্যন্ত সুকৌশলে তাঁর গোপন অ্যাজেন্ডা হিন্দুত্ববাদকে এখনো গণতন্ত্রের আবরণে ঢেকে চলেছেন। যদিও বলা যায় রাষ্ট্রে তাঁর কর্তৃত্ববাদী চেহারা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। প্রশ্ন হলো ব্যবস্থার ন্যায্যতার কী মূল্য যদি আদর্শের (এবং মূল্যবোধের) ন্যায্যতা টিকতে না পারে? আদর্শের অনুপস্থিতি কার্যত মূল্যবোধের অবক্ষয় ডেকে আনে।
আর মূল্যবোধের ক্ষয় পাওয়ার অর্থ মনুষ্যত্বের গভীর সংকট সৃষ্টি হওয়া। সমাজে সেই সংকট নানাভাবে ফুটে উঠছে, কেবল আমাদের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপীই তা চলছে। দেখুন, আমরা আলোচনার নিজস্ব গতি ও পরিণতিতে কোথায় এসে পৌঁছেছি। কবুল করতে হচ্ছে যে গণতন্ত্র চলছে, তাতে তো মনুষ্যত্বের সংকট তৈরি হচ্ছে। ভোটের মূল্যেই মানুষের মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে যে রাজনীতি, তার নিজের কোনো মূল্যবোধ নেই। এই রাজনীতি আদতে দেশ ও মানুষের সেবার অধিকারের সঙ্গে কর্তৃত্বের চাবিকাঠিও বিজয়ীর হাতে তুলে দেয়। সেবা একটি মূল্যবোধ, তাই এর কেতাবি কিংবা আলংকারিক মূল্য আছে, কিন্তু প্রকৃত মূল্য হলো ক্ষমতার এবং তা খাটানোর অধিকার কতটা ভোগ করা যাচ্ছে, তার। তাই সব বিজয়ীই চান প্রশ্নাতীত ক্ষমতা ও অবস্থান, অর্থাৎ জবাবদিহিমুক্ত স্বাধীন অধিকার। ট্রাম্পের পক্ষে মোদি বা এরদোয়ানের মতো বেপরোয়া হওয়া সম্ভব হবে না বলেই ভাবতে চাই। কারণ, প্রায় সোয়া দুই শ বছরের আমেরিকান গণতন্ত্র অনেক সফল প্রতিষ্ঠান গড়েছে এবং সেই সঙ্গে অনেক সচল প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধও তৈরি করেছে। সমাজে এসবের শিকড় যথেষ্ট গভীর, একজন ট্রাম্প একটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে তা ওপড়াতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না। ভারতেও মোদিকে অনেক ক্ষেত্রে আপস কিংবা গতি শ্লথ করতে হয়েছে, কারণ তাঁদের সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সবটা আপসকামী নয়, স্বাধীন অবস্থান রক্ষায় ও আদর্শিক লড়াইয়ে অনেকেই প্রস্তুত এবং তাতে শামিল হচ্ছেন। তুর্কিরা পুরোনো যোদ্ধা জাতি, আবার তেমনি সমাজ সুপ্রাচীন সুফি আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সেখানে কট্টরপন্থীদের ওপর অতিনির্ভরতার ফলাফল কী দাঁড়াবে বলা মুশকিল। তবে তাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বেশ বিবর্ণ, আতাতুর্ক চেয়েছিলেন রাতারাতি আধুনিক ইউরোপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। জবরদস্তি ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। তাই তুরস্কের গণতন্ত্রের খুঁটি ছিল সামরিক বাহিনী বা জেনারেলদের ইচ্ছাধীন! এবার বোধ হয় বাংলাদেশের দিকে চোখ ফেরাতে পারি।
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রয়াস হোঁচট খায় দুই তরফে—দলীয় লোকজনের ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জাসদের হঠকারী অতি বা প্রতিবিপ্লবী কর্মকাল। তাঁকে, অনিচ্ছায় হলেও, বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকেই যেতে হলো। এখন সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত, সরকার ও দলের অন্যদের ক্ষমতা-যোগ্যতার চেয়েও আনুগত্যের গুরুত্ব যে বেশি, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। এ বাস্তবতায় আদর্শগত বিচারে নিশ্চয় গণতন্ত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে। শেখ হাসিনার দেশপ্রেম তর্কাতীত, মানুষের জন্য ভালোবাসা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই, হয়তো গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধাবোধেও কমতি নেই। যদি গণতন্ত্রকেই সাক্ষী মেনে প্রশ্ন করা যায়, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে তাঁর বিকল্প কে আছেন? না, অনেকের মনে যে নামটি আসবে তিনি কোনোভাবেই হাসিনার বিকল্প নন। কারণ, বাংলাদেশের নিয়তি পাকিস্তান হওয়া নয়, তাকে বাংলাদেশই হতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি আমাদের বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠবে। তবে তার চেয়েও জরুরি হলো বাংলাদেশের স্বতন্ত্র স্বকীয় দর্শনটি স্পষ্ট করা, যাতে এ দেশে রাজনীতির ভিত্তিরেখাটি স্পষ্টভাবে দাঁড় করানো যায়। কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা একাত্তরের ইতিহাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ কাজ করে দেবে না। তবে তার আগে স্বীকার করতে হবে যে দেশ ও বিশ্ব বর্তমানে এমন একটা ঘূর্ণিপাকের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যখন গণতন্ত্রের আবরুটুকু বাঁচানোকেই নেতারা যথেষ্ট ভাবছেন,
পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কথা আপাতত তুলে রাখছেন। এ নিয়ে স্বভাবতই অনেকের অভিযোগের কমতি নেই। ঠিক আছে, কিন্তু সত্যিই যে ঘূর্ণিপাকে জেরবার হওয়া যুগান্তরেই আছি আমরা, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। ঘূর্ণিস্রোতে বেসামাল তরণিতে একনায়কের উত্থান ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তাহলে আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে এটা সত্যিই গণতন্ত্রের আকাল। আকালের গণতন্ত্র তার বৈভব দেখাতে চাইছে বৈষয়িক চাকচিক্যে, তারই বহর ও নহর দেখছি আমরা। এর প্রবাহে সারা দেশে গণতন্ত্রের খুদে খুদে অতন্দ্র প্রহরীরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দখল বুঝে নিচ্ছে। গণতন্ত্রের আবরু রক্ষা হচ্ছে কি না জানি না। কিন্তু বুঝি যে জিয়াউর রহমানের ফর্মুলাই জয়ী হচ্ছে, রাজনীতি রাজনীতিকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে, প্রক্রিয়ার মধ্যে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে বণিকদের রাজনীতিক জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন নয়তো নিজেরা বণিক হয়ে টিকে থাকার লড়াই করছেন। অবশ্য গণতন্ত্র আদতে ক্ষমতার রাজনীতি নয়, অধিকারের রাজনীতি। সবার, বিশেষ করে দুর্বল ও প্রান্তজনের, আজকের দিনে গাছপালা, পশুপাখি, মাছ, কীটপতঙ্গ, এমনকি নদী-পাহাড়-জলাশয়ের অধিকার রক্ষার জন্যও শর্ত আরোপ হতে পারে, কারও ক্ষমতার জন্য নয়। এ অর্থে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পরিসর বাড়ছে। আসুন, আমরা এক হয়ে সবার অধিকার আদায়ের কথা ও কাজে নেমে পড়ি। সেটাই গণতন্ত্রের দাবি আমাদের কাছে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.