অবৈধ পথে আসছে প্রবাসী আয়

দেশে ব্যাংকিং চ্যানেল ও খোলাবাজারে মার্কিন ডলারের দামের পার্থক্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ টাকার বেশি। ব্যাংকে প্রতি ডলারের মূল্য গড়ে ৭৮ টাকা, খোলাবাজারে তা ৮২ টাকার কাছাকাছি। একইভাবে প্রবাসীরাও অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে দুই ধরনের প্রস্তাব পাচ্ছেন। বেশি টাকার আশায় অনেকেই অবৈধ পথকে বেছে নিচ্ছেন। আবার নগদ ডলারের সংকটের প্রভাবও পড়ছে প্রবাসী আয়ে। এতে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে দেশের প্রবাসী আয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে এমন তথ্য উঠে আসার পর গতকাল সোমবার প্রবাসী আয় আহরণকারী শীর্ষ ৩০টি ব্যাংকের সঙ্গে সভা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর সভাপতিত্বে এসব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা সভায় অংশ নেন। সভায় প্রবাসী আয় আহরণের দিকে নজর দিতে এমডিদের তাগিদ দেওয়া হয়। প্রবাসী আয় কমছে কেন, খতিয়ে দেখা হোক—প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত এ সভার আয়োজন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এিদকে, অর্থমন্ত্রীও প্রবাসী আয় অবৈধ পথে আসছে বলে গতকাল মন্তব্য করেছেন। গতকাল বাজেট তদারকি ও সম্পদ কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশে প্রবাসী আয় কমার একটি কারণ হচ্ছে বিদেশ থেকে হুন্ডি বা অবৈধ পথে দেশে অর্থ আসা। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আমাকে বলেছে, কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে তারা। ডলারের দর ৮০ টাকার মতো হয়েছে তো, আশা করছি সমস্যাটা মিটে যাবে এবং প্রবাসী আয় বাড়বে।’ হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো নয় উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘হুন্ডির মাধ্যমে ভারতবর্ষ ঘুরে দেশে প্রবাসী আয় আসে। এতে এদের (হুন্ডির দালাল) কিছু লাভ হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে দেশে প্রবাসী আয় আসা কমেনি।’ গতকালের বৈঠক উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে নগদ ডলারের সংকট রয়েছে। এ সংকটের কারণে ব্যাংক ও খোলাবাজারে দামের পার্থক্য বাড়ছে। ফলে অবৈধ পথে প্রবাসী আয়ও বাড়ছে। নগদ ডলার আমদানি করা গেলে এ সংকট দূর করা যেত। জানা গেছে, সবশেষ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক নগদ ৩৫ লাখ ডলার আমদানি করে। তবে কর আরোপ থাকায় অন্য কেউ আর ডলার আনতে রাজি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডলার আমদানিতে কর অবকাশ-সুবিধা দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হলেও কর প্রত্যাহার করা হয়নি।
পর্যবেক্ষণমতে, ডলারের বিপরীতে পাউন্ড, ইউরো, রিঙ্গিত, সিঙ্গাপুর ডলারসহ প্রভৃতি মুদ্রার মূল্যমান কমে গেছে। ফলে এসব দেশের শ্রমিকদের আয়ের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকা কম পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি তেলের দাম কমায় শ্রমিকদের আয় কমে গেছে। অনেক দেশে শ্রমিকদের বেতনও অনিয়মিত হয়ে গেছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ থেকে অর্থ পাঠাতে প্রবাসীদের হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। পাঠানো টাকার প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা, তা জানতে চাইছে। বৈধ সময়ে কাজের আয় ছাড়া অন্য আয় পাঠানো যাচ্ছে না। এতে আরও উঠে এসেছে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশে বিকাশের নামে টাকা গ্রহণ করা হচ্ছে। এতে ডলারের বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে। এর পুরোটাই অবৈধ পথে দেশে আসছে। এসব কারণে ক্রমেই প্রবাসী আয় কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, ধারাবাহিকভাবেই কমছে প্রবাসী আয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে প্রবাসীরা ৪২৫ কোটি ৫৭ লাখ মার্কিন ডলার প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫০৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী আয় কমেছে ৭৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বা ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে প্রবাসীরা ১০১ কোটি ৯ লাখ ডলার প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন, যা গেল অর্থবছরের একই মাসের চেয়ে ৮ কোটি ৭৪ লাখ ডলার বা ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ কম। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ১০৫ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, যা আগের বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ১৩৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে কমছে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ। এসব পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে গতকালের সভায় আলোচনা হয়, এক্সচেঞ্জ হাউস চালুর সময়ে নিরাপত্তা হিসেবে রাখা হয়েছিল ২৫ হাজার ডলার। এর পরিমাণ কমিয়ে আনতে কাজ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলোর ব্যয় কিছুটা কমবে। পাশাপাশি ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোকে এজেন্ট নিয়োগ করে প্রবাসী আয় আহরণ করার বিষয়ে তাগাদা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সভার বিষয়ে এস কে সুর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, প্রবাসী আয় প্রদানকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যাংকিং চ্যানেলে সব আয় আনার ব্যবস্থা করতে এমডিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রবাসী গ্রাহকদের নিয়ে গ্রাহক সমাবেশ, আলোচনা করার তাগিদও দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসে কোন ব্যাংকের মাধ্যমে কী পরিমাণ প্রবাসী আয় আসে, তা দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.