এটি কি ভারতের কূটনীতির ভারসাম্য?

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহযোগিতা নতুন কোনো চিন্তা নয়। এর আগেও তারা পারমাণবিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার স্বাক্ষর রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক চুক্তির মধ্য দিয়ে নতুন যে সহযোগিতার দ্বার উন্মোচিত হল, তা অবশ্যই সিগনিফিকেন্ট। এখানে একটি বিষয় আছে, পাকিস্তানের মতো লো ক্লাস রাষ্ট্রের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে এবং তারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বলে অভিযুক্ত, যারা সন্ত্রাসের প্রসার ঘটাচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে। বিষয়টিকে এখন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা বড় হুমকি ভাবা হচ্ছে। যদিও চীন-পাকিস্তান সহযোগিতা এবং পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সহযোগিতার বিষয়টি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য, তবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ চুক্তি ভারত মহাসাগরে রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন মেরুকরণ ঘটাবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দক্ষিণ চীনে চীনের যে আধিপত্য বিস্তারের মনোভাব, সেটিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উৎসাহী করেছে ভারতের সঙ্গে এ ধরনের একটি স্ট্র্যাটেজিক কো-অপারেশন গড়ে তুলতে। ভারত-মার্কিন সহযোগিতা আমাদের অঞ্চলের নিরাপত্তা স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখবে এবং ভবিষ্যতে অনিরাপত্তার জায়গাগুলোকে একটু ছোট করবে। পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন অনুরাগের যে বিষয়টি ছিল, সেটি থেকে বের হয়ে আসতে পারলে পাকিস্তানের যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যা নিয়ে ভারত-আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ সব সময় অনিরাপত্তায় ভোগে,
তা থেকে মার্কিন সমর্থন দূরে নিয়ে আসা যাবে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়বে। পাকিস্তানের ওপর মার্কিন চাপ বৃদ্ধি পেলে আমাদের অঞ্চলে যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, তা হ্রাস পাবে। এর সঙ্গে জন কেরির বাংলাদেশ সফরের বিষয়টিও আমি যুক্ত করতে চাই। বাংলাদেশে মার্কিন সম্পর্কের একটি নতুন মোড় দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশ-মার্কিন সহযোগিতার বৃত্তে অনেক কিছু থাকলেও সেখানে গভীরতা সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে মার্কিন অবস্থান এতদিন যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তা সম্পর্কের গভীরতা তৈরিতে একটি বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছে। জন কেরির সফরে আমরা দেখেছি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নিন্দা ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করা হয়েছে। এ নিরিখে আমরা বলতেই পারি, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ-ভারত ও মার্কিন সম্পর্কের বিষয়টি বেশ কিছুটা এগিয়ে গেল। ভারত যে বিশ্বে একটি উচ্চমানের শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে, সেই শক্তির প্রতি মার্কিন সহযোগিতা স্বভাবতই আন্তর্জাতিক মেরুকরণে প্রভাব রাখবে। ভারত যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে যাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মার্কিন সামরিক সহযোগিতার বিষয়টি রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি না ঘটালেও কিছুটা বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করবে। আমি মনে করি, এ ধরনের চুক্তি চীনকে সামান্য হলেও শংকিত করবে। এ অঞ্চলে চীনের তো একটা অবস্থান আছে। এ অবস্থায় বাইরের কোনো শক্তি এসে যখন একটি অঞ্চলে সহযোগিতার সেতুবন্ধ তৈরি করছে, সেটিকে স্বভাবতই তারা হুমকি মনে করবে। সে ক্ষেত্রে চীনের বিরোধিতা একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হবে। আরেকটি বিষয় হল, চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব অস্বাভাবিকতা না থাকলেও পরস্পরের কাছে যাওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে,
যদিও অরুণাচল প্রদেশ ও অন্যান্য সমস্যা খুব একটি গতি পায়নি। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এটি প্রভাব ফেলবে এবং চীন-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন বাঁক সৃষ্টি হবে।রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের এবং এর একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। এ অবস্থায় যুুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বা বেশি ঘনিষ্ঠতা রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক হালকা করে তুলবে বলে আমি মনে করছি না। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক হালকা করে ভারত আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরিতে আগ্রহী হবে- এমন পর্যায়ে ভারত যাবে বলে আমি মনে করি না। ভারতের এ নীতিকে আমরা বলব পররাষ্ট্রনীতির একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান। এ ধরনের চিন্তা যারা করছেন, আমি বলব, তারা কল্পনার রাজ্যে বাস করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যখন পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি হল কংগ্রেসের সময়, তখন বামজোট এটিকে ইস্যু করে সরকার থেকে বের হয়ে গিয়েছিল এ আশায় যে, তারা জনসমর্থন পাবে। পরে নির্বাচনের সময় দেখা গেল, বামদের ভরাডুবি শুরু হয়েছে। ওই ইস্যুতে বিরোধিতা করেও ভারতীয় জনগণের সমর্থন তারা পাননি- এটা হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য। একই বিষয়ে অন্য কেউ অবস্থান নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারবেন- এমনটি আমি মনে করি না। মেজর জেনারেল মো. আব্দুর রশীদ (অব.) : স্ট্র্যাটেজি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। ইন্সটিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (আই ক্ল্যাডস)-এর নির্বাহী পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.