ব্রাজিল সংকটের শেষ নাকি শুরু

রুসেফের বিদায় : শপথের পর অফিসে এসেছেন
ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট মিচেল তেমের (বাঁয়ে)।
আলভোরাদা প্রেসিডেন্ট প্যালেসে বুধবার বক্তব্য
রাখছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ -এএফপি
রাষ্ট্রীয় অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে ব্রাজিলের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফকে। তরুণ বয়সে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়েছেন তিনি, পরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বসেছেন দেশের সর্বোচ্চ পদে। অবশেষে বুধবার অবমাননাকরভাবে তিনি বিদায় নিয়েছেন। তবে সিনেটে রুসেফের অভিশংসন শুধু এক নারীর বিদায়ের উপাখ্যান নয়। দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে নজিরবিহীন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়েছিলেন রুসেফ। তবে তিনিই এক সময় দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার লড়াইয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও শেষ রক্ষা হল না। রুসেফের বিদায়ের মাধ্যমে দেশটিতে ১৩ বছর ধরে চলা বামঘেঁষা ওয়ার্কার্স পার্টির শাসনের অবসান হল। তবে ব্রাজিলের এ সংকট অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে সৃষ্টি রাজনৈতিক উত্তেজনা থেকে আলাদা কিছু নয়। দক্ষিণ আফ্রিকাও একই সমস্যার মুখোমুখি। সেখান ক্ষমতাসীন এএনসি দলের বিরুদ্ধেও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। চীনের স্বৈরশাসনও দুর্নীতিগ্রস্ত। তবে এসব উদাহরণ রুসেফের অপকর্ম ঢাকার পক্ষে কোনো যুক্তি নয়। মনে রাখতে হবে যে, একজন নারীকে সরিয়ে দিতে একটি ভোট দিলেও সংকটের সমাধান হয়ে যায় না। ব্রাজিল এখন চরমভাবে বিভক্ত এবং মেরুকরণ কবলিত একটি দেশ। ব্রাজিলের নতুন নেতা মিচেল তেমের যদি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারেন তবে সংকট আরও বাড়তে থাকবে।
নয়া প্রেসিডেন্ট মিচেল তেমের : ব্রাজিলের সিনেট প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফকে স্থায়ীভাবে সরিয়ে দেয়ার পর ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট মিচেল তেমের। বুধবার সিনেটের ভোটাভুটিতে ৬১-২০ ভোটে ব্রাজিলের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট রুসেফের বিদায় নিশ্চিত হয়। চলতি বছরের মে মাসে রুসেফ বরখাস্ত হওয়ার পর থেকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন রুসেফ সরকারের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট তেমের। শপথ নেয়ার পর টেলিভিশনে সম্প্রচারিত জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে তিনি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও ১১ শতাংশ বেকারত্ব মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে তাকে সমর্থন দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য চীনের উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে দেয়া ভাষণে রক্ষণশীল এ নেতা বলেন, ‘এই মুহূর্তটি ব্রাজিলের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার আশা জাগিয়েছে। অনিশ্চয়তা শেষ হয়েছে।’ রুসেফের অপসারণ ব্রাজিলের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে বলে আশা করছেন তার বিরোধীরা। মাত্র কয়েক বছর আগেও ব্রাজিল একটি দ্রুত বাড়তে থাকা অর্থনীতির দেশ ছিল, বিশ্বে দেশটি মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। কিন্তু এরপর ব্রাজিল মন্দার কবলে পড়ে, যা এক সময় গভীর হয়ে ওঠে। এরপর রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পেট্রোব্রাসের ঘুষ কেলেংকারি প্রেসিডেন্ট রুসেফের জোট সরকারে কালো ছায়া ফেলে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে, তারা রুসেফের পদত্যাগ দাবি করে।
এর মাত্র আড়াই বছর আগে ব্রাজিলের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় বারের মতো নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। পেট্রোব্রাসের কেলেংকারি সঙ্গে রুসেফের কোনো সংস্পর্শ না থাকলেও তার জোট সরকারের শরিক অনেক নেতা এবং ব্রাজিলের ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকেই জড়িত আছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পেট্রোব্রাসের তদন্তে শরিকদলীয় অনেক নেতা ও কংগ্রেস সদস্য গ্রেফতার হওয়ার পর একসময় প্রেসিডেন্ট রুসেফের বিরুদ্ধে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে দেখানোর অভিযোগ ওঠে। বলা হয়, ২০১৮-র নির্বাচনে সুবিধা পেতেই এমনটি করেছেন তিনি। এ অভিযোগেই অভিশংসনে কংগ্রেসের ভোটে বরখাস্ত হন তিনি। এরপর তিন মাস শুনানি শেষে স্থায়ীভাবে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপসারিত হন। নতুন প্রেসিডেন্ট তেমের তার অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি সফল করতে চান। যার মধ্যে বেসরকারিকরণ, জনকল্যাণমূলক পেনশন ও জনকল্যাণ আইন এবং সরকারি ব্যয়ের উচ্চমাত্রা কমিয়ে আনা অন্যতম। আইনপ্রণেতারা তার এসব কর্মসূচিকে সমর্থন করবেন বলে আশা করছেন তিনি। তবে এসব করতে গিয়ে তেমেরকে এই মুহূর্তে বিরোধী দলে পরিণত হওয়া ওয়ার্কার্স পার্টির তীব্র বাধার সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সরকারের বিরোধিতায় আসছে দিনগুলোতে কংগ্রেস ও রাস্তা, উভয় জায়গায় ওয়ার্কার্স পার্টি তাদের শক্তি প্রদর্শন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক টানাপড়েন : রুসেফকে অপসারণ করার পর ব্রাজিলের সঙ্গে বাম-শাসিত ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়েছে। রুসেফের অপসারণকে ক্যু বা অভ্যুত্থান আখ্যা দিয়ে বুধবার ভেনিজুয়েলা, ইকুয়েডর ও বলিভিয়া তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জবাবে ব্রাসিলিয়াও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ভেনিজুয়েলার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো অভিযোগ করেছেন, রুসেফের অপসারণের নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্র। জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘এই অভ্যুত্থান শুধু দিলমার বিরুদ্ধে নয়, এটা ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ার বিরুদ্ধে। এটা আমাদের বিরুদ্ধে। এটা জনপ্রিয়, প্রগতিশীল ও বামপন্থী আন্দোলনের ওপর আঘাত।’ সংসদীয় ক্যু-রুসেফ: সিনেটের ভোটে স্থায়ীভাবে অপসারিত হওয়ার পর দিলমা রুসেফ বলেছেন, তার অভিশংসন একটি সংসদীয় ক্যু এবং তিনি আবার প্রত্যাবর্তনের আশা ব্যক্ত করেছেন। বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি ও গার্ডিয়ান

No comments

Powered by Blogger.