সবই করা হচ্ছে চীনকে টার্গেট করে

গত সোমবার, ২৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত পরস্পরের স্থলভূমি, আকাশ ও নৌঘাঁটি ব্যবহারের সুযোগ রেখে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এ চুক্তিটিকে Logistics Exchange Memorandum of Agreement (LEMOA) বলে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ চুক্তি অনুসারে শুধু জ্বালানি সরবরাহ, যৌথ মহড়া, মানবিক ত্রাণ কাজের মতো বিষয়গুলোতে দুই দেশ একে অপরের ঘাঁটি ব্যবহার করতে সহযোগিতা করবে। চুক্তি স্বাক্ষর করার পর ওয়াশিংটনে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার বলেছেন, এ চুক্তি দ্বারা দুই দেশের সামরিক বাহিনীর যৌথ অভিযানে উপকরণগত সহযোগিতা আরও কার্যকর ও সহজ হবে। অন্যদিকে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকরের মতে, সামরিক এ চুক্তির ফলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-সৈন্যরা সহজে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারবে। সেই সঙ্গে মহড়ায় অংশ নেয়া ও মানবিক সহায়তা দেয়ার সময়ও তারা খুব সহজেই একসঙ্গে কাজ করতে পারবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক উঁচু মাত্রার সহযোগিতার উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম এরই মধ্যে চুক্তির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে। তাদের ভাষায় এ চুক্তি দ্বারা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সম্পর্কে এক ’উল্লম্ফন’ ঘটেছে। ‘ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে সরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক নতুন মৈত্রীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’
তবে তাদের মন্তব্যে এক ধরনের সতর্কতাও আছে। ‘যদি ভারত তাড়াহুড়া করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় তাহলে এ পদক্ষেপ চীন, পাকিস্তান, এমনকি রাশিয়ার জন্য অসন্তোষ তৈরি করতে পারে। এর ফলে ভারত নিরাপদ হবে না বরং কৌশলগতভাবে ঝামেলায় পড়ে যেতে পারে; এশিয়া অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।’ অন্যদিকে ভারতের ভেতরও এক ধরনের মিশ্র মতামত লক্ষ করা যাচ্ছে। কেউ বলছেন, এর ফলে ভারতের ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের প্রবেশের সুযোগ তৈরি হল। আবার কারও মতে এটা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক জোট গড়ার এক চুক্তি যা ভারতের জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির বিরোধী ও দেশটির সার্বভৌত্বের লংঘন। গত শতাব্দীর নব্বই দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের ভেতর যে গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সামরিক চুক্তি হয়েছে সন্দেহ নেই। অথচ ভারত বিভক্তির পর উপমহাদেশের দুটি দেশের মধ্যে পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র, যার সঙ্গে পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং সিয়াটো ও সেন্টো সামরিক চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র আবদ্ধ হয়েছিল। অপরপক্ষে ভারতের জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার বিষয় ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ নীতি ছিল ‘অনৈতিক নিরপেক্ষতা (immoral neutrality)’।
ভারত বরং সোভিয়েতের মিত্র হয়ে উঠেছিল তার জোটনিরপেক্ষতা এবং বর্ণবাদ-উপনিবেশবাদ-নিরস্ত্রিকরণনীতির জন্য। অথচ স্নায়ুযুদ্ধ অবসান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন বন্ধু খোঁজার দরজা খুলে দিল। যে যুক্তিতে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পেত (সোভিয়েত বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিত) তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়ায় দেশটি আগের গুরুত্ব হারাল যখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের গুরুত্ব বেড়ে গেল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা নির্মাণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে ভারত ততদিনে আঞ্চলিক শক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নতুনভাবে তার দক্ষিণ এশীয় নীতি প্রণয়ন করতে শুরু করে। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথ নৌমহড়া শুরু করেছিল যার ধারাবাহিকতায় স্থল ও বিমান বাহিনীর মধ্যেও যৌথ মহড়া সম্প্রসারিত হয়েছিল। লক্ষ করার বিষয়, নতুন অর্থনৈতিক নীতির ফলে চীনের অর্থনীতিতে যে বিরাট পরিবর্তন সংঘটিত হয় তা দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্যকে জোরালোভাবে পরিচালনার তাগিদ সৃষ্টি করেছিল। এ তাগিদ থেকে চীন তার ভূখণ্ডের সন্নিহিত সমুদ্রপথকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেছে তেমনই নিজ সমুদ্র অঞ্চলকেও সম্প্রসারিত করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তার বিরোধ আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে জটিলতা তৈরি করায় প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন সামরিক সহযোগিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সাম্প্রতিক চুক্তি নিয়ে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবাধ নৌ ও বিমান পরিবহন এবং নির্বিঘ্ন বাণ্যিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সমান আগ্রহী। তাদের কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একাধিপত্য তৈরিতে তাদের জোরালো আপত্তি আছে এবং তাদের আপত্তিকে তারা সামরিকপেশি দিয়ে প্রকাশ করতে চান।
২০১৫ সালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র Joint Strategic Vision for the Asia-Pacific and Indian Ocean Region নাম দিয়ে এক ঘোষণায় চীনের সঙ্গে সমুদ্র অঞ্চল নিয়ে বিরোধকে সামনে নিয়ে এসেছিল। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে সমুদ্র নিরাপত্তা এবং নৌ ও বিমান চলাচলের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার ব্যাপারে প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল। এ ঘোষণা থেকে কিছু উদ্ধৃতি বিষয়টি বোঝার জন্য প্রাসঙ্গিক হতে পারে। ‘নিরাপত্তার সঙ্গে আঞ্চলিক সমৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। আমরা সমগ্র অঞ্চল, বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগরে নৌ নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ এবং সমুদ্র চলাচল ও বিমান যাত্রাকে নির্বিঘ্ন করতে চাই ... আমরা সব পক্ষকে হুমকি অথবা শক্তি ব্যবহার করা পরিহার করতে বলি এবং শান্তিপূর্ণভাবে আঞ্চলিক ও নৌ বিরোধের সমাধানের আহ্বান জানাই।’ এটা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে চীনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এ ধরনের সহযোগিতার তাৎপর্য সবার কাছে একভাবে দৃশ্যমান হবে না। সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, চীন তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিটিকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু সেটা কতদূর চীনের ভেতরের কথা তা নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। গত বছরের স্ট্রাটেজিক ভিশন ঘোষণা এবং বর্তমান চুক্তিকে বিশ্লেষণ করে বলা যায়, চীন আপাত স্বাগত জানালেও বিষয়টির ওপর তার নিশ্চয় তীক্ষè নজর থাকবে। কারণ তাকে উদ্দেশ করে এসব পদক্ষেপ নেয়া হলে দক্ষিণ চীন সাগরে তার যে লক্ষ্য তা বাধাগ্রস্ত হবে যা তার কাম্য হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক দ্বারা সামরিক সম্পর্ক প্রভাবিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ক্রমান্বয়ে ভারতের প্রতিরক্ষা চাহিদা পূরণ, বিশেষ করে গত কয়েক বছরে তার কাঙ্ক্ষিত অস্ত্রের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারীতে পরিণত হওয়া এবং তাদের মধ্যে ঘন ঘন যৌথ মহড়া- এগুলো সবই চীনকে লক্ষ্য করে করা হচ্ছে। এশিয়া অঞ্চলে চীনের ‘মুক্তোমালানীতি’র বিপরীতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের চীনকে মোকাবেলা করার নীতি ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার কী প্রভাব ফেলবে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে।
ড. আকমল হোসেন : অধ্যাপক (অব.), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
akmalhussainir@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.