দৌড়ের ওপর আছি

অতঃপর উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায় ভরা দীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষ হলো। মঙ্গলবার খুব ভোরের দিকে মুঠোফোনের খুদে বার্তার শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। তুরস্কে সাংবাদিকদের যেভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপারটা একদম সাধারণ হয়ে গেছে। বার্তাটি পাঠিয়েছিল ইস্তাম্বুলে আমার অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের দারোয়ান: ‘জনাব ইয়াভুজ, কিছুক্ষণ আগে পুলিশ এক চাবিওয়ালাকে নিয়ে আপনার ফ্ল্যাটে ঢুকেছে। তারা তল্লাশির সময় জিিনসপত্র নষ্ট করেনি বা কিছু নিয়েও যায়নি। তারা আমাদের বলেছে, আপনার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।’ যাক, শেষমেশ পুলিশ সঠিক নিয়মেই তল্লাশি চালিয়েছে, এ কথা ভেবে আশ্বস্ত বোধ করলাম। আমার স্ত্রী তখন ইজিয়ান সাগরের উপকূলে ছিলেন। আমি তাঁকে ফোন করলাম। একবার ভেবে দেখুন, আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এভাবে তছনছ করার ঘটনায় তিনি কতটা ধাক্কা খেতে পারেন। তবে আমার কিছু হয়নি। আমি ব্যাপারটা ভালোভাবেই জানি। ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরিণতি হচ্ছে, তুরস্কে যতটুকু মর্যাদা নিয়ে সাংবাদিকতা করা যেত, সেটাও আর করা যাবে না। এর আগে ৭২ বছর বয়সী তুরস্কের সবচেয়ে শক্তিশালী, সৎ ও উদার কলামিস্ট শাহিন আলপাই ও বর্ষীয়ান প্রতিবেদক লালে কামালকে গ্রেপ্তারের পর আমি জানতাম, একদিন আমার দিনও আসবে। এই ধরপাকড় শুরু হওয়ার আগেই আমাদের স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্যের ওপর হামলার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। ক্রমেই তা বাড়ছিল। কুর্দিপন্থী সংবাদপত্র ওজগুর গুনদেম বন্ধ করে দেওয়া ও আসলি এরদোয়ানের মতো লেখককে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ আরেক কুর্দি সংবাদপত্র আলাদিয়া বেলাত-এ অভিযান চালায়।
দিয়ারবাকিরের এই পত্রিকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ২৭ জন কুর্দি কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন টিআরটির ৩৬ জন কর্মীকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়। গত সপ্তাহটা আমরা শুরু করেছিলাম প্রচণ্ড চাপ নিয়ে, সহকর্মীদের কাছে আমরা খুদে বার্তা পাঠাতাম: ‘সতর্ক থাকবেন।’ এ ছাড়া আমরা আর কী করতে পারতাম? আমরা একদিকে দুর্বল, অন্যদিকে ইউরোপীয় রাজনীতিকেরা আমাদের পরিত্যাগ করেছে। মঙ্গলবার সকালে জানলাম, মুরাত আকসয়কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সামাজিক গণতন্ত্রী মুরাত শুধু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে মন্তব্য কলামই লেখেন না, তিনি সম্প্রতি সিএইচপি নেতা কেমাল কোদুসকাগোলুর প্রেস সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। সেদিন সকালে আরও জানলাম, আমার বাসার কাছে আলি ইয়ুরতাগিলের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। আলি আমার মতোই ইংরেজি পত্রিকা টুডেস জামান-এর কলামিস্ট ছিলেন। এ বছরের শুরুর দিকে তুর্কি সরকার জোরপূর্বক পত্রিকাটি দখল করার আগ পর্যন্ত তিনি এতে কাজ করতেন। তিনি অনেক দিন ধরেই ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের তুরস্কবিষয়ক উপদেষ্টা। অনেক সম্মানের সঙ্গে তিনি এ কাজ করছেন। এরপরই আরেক দফা ধরপাকড়ের খবর পেলাম। সেদিন ৩৫ জন সাংবাদিককে খোঁজা হয়েছে। ‘গণশত্রুদের’ নতুন তালিকা দেওয়া হয়েছে। এতে আমার নামও রয়েছে।
মঙ্গলবার রাতের মধ্যে জানতে পারলাম, ওই তালিকার অন্তত নয়জনকে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, তাঁদের ৩০ দিন পর্যন্ত বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা হতে পারে, জরুরি আইনে এমন বিধান রয়েছে। কিন্তু এসব কেন হচ্ছে? সেদিন আইনজীবীকে দিয়ে যত চেষ্টা করিয়েছিলাম, সন্ধ্যা নাগাদ তার কোনোটাই আলোর মুখ দেখল না। এই কলাম লেখার সময়ও আমি আসলে জানি না, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কী? কারণ, আমার আইনজীবী বলেছেন, ‘এই ধরপাকড়-সংক্রান্ত সব ফাইল গোপনীয়।’ পাঠকের কাছে ব্যাপারটা ধাঁধার মতো মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি, সাংবাদিকদের এ রকম ধ্বংসাত্মক পন্থায় টার্গেট করার মানে কী। সেই গেজি পার্কের সামনে আন্দোলন শুরু হওয়ার সময় থেকেই এটা একরকম স্পষ্ট। ধরপাকড়ের যুক্তিটা খুব সাদামাটা ও সোজাসাপ্টা। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের কড়া শাসনের আমলে তুর্কি সরকার ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ দিয়ে অ্যাজেন্ডা ভরে ফেলতে চাচ্ছে, যাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হয়। তুর্কি গণমাধ্যমের বড় একটি অংশকে এভাবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। কারণ, তাদের গায়ে ছাপ মারা হয়েছে, তারা গুলেনের আন্দোলনের অংশীদার। আর সব কুর্দি গণমাধ্যম যেন পিকেকের হয়ে কাজ করছে। কথা হচ্ছে,
আপনি কী সংবাদ প্রতিবেদন লিখলেন বা মন্তব্য করলেন, সেটা সমস্যা নয়। আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেটাই আসল কথা। আপনি যতক্ষণ এরদোয়ানের ব্যাপারে সমালোচনামুখর ও প্রশ্নশীল থাকবেন, ততক্ষণ আপনি অবাঞ্ছিত। এ পর্যন্ত থাকলে আপনার হয়তো চাকরি চলে যাবে। কিন্তু আপনি যদি স্বাধীন সাংবাদিকতার ব্যাপারে গোঁ ধরে থাকেন, তাহলে আপনাকে গ্রেপ্তার হতে হবে। গতকাল শনিবারের আগের শনিবার প্ল্যাটফর্ম ফর ইনডিপেনডেন্ট জার্নালিজম (পি ২৪) জানিয়েছিল, ১০৮ জন সাংবাদিক কারাগারে। আর নতুন ধরপাকড়ের মধ্য দিয়ে সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবে ১৫০ ছোঁবে। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্ষমতাসীন একেপি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সাংবাদিকতার শত্রুর তালিকায় ওপরের দিকে থাকবেন। অন্য কয়েকটি একনায়কতন্ত্রের সম্মিলিত অবস্থানের চেয়েও তাঁরা ওপরের দিকে থাকবেন। তা সত্ত্বেও মনে হয়, পাশ্চাত্যের অনেকেই বিশ্বাস করেন, সাংবাদিকদের এই দুরবস্থা আসলে ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা-পরবর্তী ‘গণতন্ত্রের উদ্যাপনের’ অংশ মাত্র। আমি নির্বাক। অনুভূতিহীন। আমার মনটা খুবই তেতো হয়ে আছে, কারণ আমাকে ক্রন্দনরত প্রিয় মাতৃভূমি থেকে দূরে ইউরোপের একটা জায়গায় স্বেচ্ছানির্বাসনে আসতে হয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।
ইয়াভুজ বাইডার: স্বেচ্ছানির্বাসিত তুর্কি সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.