জঙ্গি দমনে রাজনৈতিক ভারসাম্যও জরুরি

দেশের রাজনীতি এক জায়গায় স্থির থাকছে না। রাজনীতি ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলাচ্ছে। আসলে দেশে কোনো সুস্থ রাজনীতিই নেই, চলছে অসুস্থ রাজনীতির প্রতিযোগিতা। বাস্তবে এর কুফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি সমাজ ও রাষ্ট্রে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে শিক্ষিত ও মেধাবীরা। অসুস্থ রাজনীতির কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরে না এলে তা রোধ করা সম্ভব নয় বলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন। কাজেই রাজনীতিকে ফিরে আসতে হবে ঐক্য ও সুস্থ ধারায়। শিক্ষিত ও মেধাবীরা যদি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ে, তারা যদি আত্মঘাতী হয়ে ওঠে, জীবন দিতে প্রস্তুত হয়- তাহলে কোথায় যাবে রাজনীতি, কোথায় যাবে দেশ, কোথায় যাবে দেশের নিরাপত্তা। এসব ভাবার সময় এখন এসেছে। এখন মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে উল্টাপাল্টা বক্তৃতা দেয়ার সময় নয়। এখন সময় দেশ নিয়ে ভাবার।
আমরা চাই না দেশের সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে যাক। আমরা এও চাই না দেশের সবাই বিএনপি হয়ে যাক। আমরা চাই ভারসাম্যের রাজনীতি। কেননা দেশটা একেবারে আওয়ামী লীগের হয়ে গেলেও বিপদ, বিএনপির হয়ে গেলেও বিপদ। গত ইউপি নির্বাচনে এ বিপদের কিছুটা আলামত আমরা দেখতে পেয়েছি। ১৯৭৪-৭৫ সালেও আমরা দেখেছি- রাজনীতিতে ভারসাম্য না থাকলে কী হয়। ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তবে ইতিহাসের শিক্ষা হল এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের জনসমর্থন প্রশ্নবিদ্ধ। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য বড় ধরনের দুর্বলতা। এ দুর্বলতা বিদেশীদের জন্য সৃষ্টি করে দিচ্ছে অবারিত সুযোগ। এ সুযোগটিই তারা নিচ্ছে এবং কাজেও লাগাচ্ছে পরিপূর্ণভাবে। বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করতে হলে দরকার একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকারের আর সেটি হতে পারে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
আসলে সংকট উত্তরণের প্রধান উপায় হল সংকটের অস্তিত্ব স্বীকার করা, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে একটা ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; এ সংকট উপলব্ধি করে সম্মানিত ব্যক্তিরা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যার যার দায়িত্ববোধ থেকে দেশে জাতীয় ঐক্য গড়তে এবং সংকট সমাধানে সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার এ হাত বাড়িয়ে দেয়াকে কোনো আমলে নিচ্ছে না। সরকারকে মনে রাখতে হবে, সুশাসন উপহার দিতে এবং জনজীবনের বিরাজমান সমস্যা সমাধানে তারা শুধু ব্যর্থই হয়নি, চরমভাবেই ব্যর্থ হয়েছেন। মনে রাখতে হবে, একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে অসম্ভব শক্তিশালী মনে হতে পারে, আবার আরেকটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনিই হয়ে যেতে পারেন পৃথিবীর দুর্বলতম মানুষ। আরও মনে রাখতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন কখনও থেমে থাকে না; অন্যায়ের জয় হয় না, মানুষের ভেতরে ভেতরে ঠিকই আন্দোলন চলতে থাকে। একসময় সেই আন্দোলন দৃশ্যমান হয়ে গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়। এসব কথা ক্ষমতাসীনদের আমলে নিতে হবে। বিপজ্জনক রাজনৈতিক পথ থেকে ফিরে আসতে হবে। জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, অযাচিত শক্তি প্রয়োগ দুর্বলতার প্রকাশ। এভাবে কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করা যায় না। কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে হলে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে আর সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রাজনীতিতে কেউ কারও শত্রু নয়,
প্রতিপক্ষ মাত্র; এ অনিবার্য বাস্তবতা মেনেই রাজনীতি করতে হয়। বিএনপির ক্ষতি আওয়ামী লীগের জন্য হিতকর নয়। অনুরূপ আওয়ামী লীগের ক্ষতিও বিএনপির জন্য মঙ্গলজনক নয়। কেননা এ দুটি দল একে অপরের ভারসাম্য রক্ষা করে। ভারসাম্য ছাড়া কোনো কিছুই সঠিকভাবে চলতে পারে না, যেমন বাংলাদেশ সঠিকভাবে চলছে না। বিএনপিকে ছাড়া আওয়ামী লীগ যেমন অচল, তেমনি আওয়ামী লীগকে ছাড়াও বিএনপি অচল। এ অনিবার্য সত্য উভয় দলকেই মানতে হবে, তাহলেই দেশে জঙ্গি হামলা, মারামারি ও রক্তারক্তি বন্ধ হবে; নয়তো কোনো নেতা-নেত্রীর পক্ষেই দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। গুলশানের হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী-জঙ্গি হামলায় দেশের ইমেজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এটি বিদেশে যারা আছেন, তারা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন। পত্রিকায় এসেছে, বহু তৈরি পোশাক ক্রেতা তাদের নির্ধারিত সভা ঢাকা থেকে অন্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছেন। এটা দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মোটেও সুখবর নয়। বিশেষ করে পোশাক শিল্পের জন্য এটা একটা অশনিসংকেত।
এসব দেখে রাজনীতিকরা চুপ থাকতে পারেন না। তাদের মধ্যে অনৈক্য ও ভেদাভেদ কাম্য নয়। এ মুহূর্তে জাতীয় ঐক্য হলে দেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হবে; দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীরা উৎসাহ পাবেন, তাদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। গুলশান ট্রাজেডি মানুষের মনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। সব শ্রেণী-পেশার মানুষই উপলব্ধি করছে, দেশ একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে। এ সংকট এখন প্রান্তসীমায় এসে উপনীত হয়েছে। এখন সবার উচিত দেশ নিয়ে ভাবা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা। কেননা দেশটা আমাদের সবার। আমাদের রাজনৈতিক বিভাজনের সুযোগ নেয়ার জন্য ওঁৎপেতে আছে দেশী-বিদেশী সুযোগ সন্ধানী চক্র। এটি আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। একজন সৎ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের প্রথম কাজ দেশ নিয়ে ভাবা। এ ভাবনাটা থাকলে দেশের বিভেদ-বিভাজন দূর হতে বাধ্য। বিভেদ-বিভাজন দূর হলেই রাজনীতিতে শান্তি ও স্থিতি প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশ থেকে দূর হবে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ। দেশ থাকবে নিরাপদ, দেশের মানুষ থাকবে নিরাপদ; বাংলাদেশ পরিণত হবে শান্তির দেশে। আমরা রেখে যেতে পারব আমাদের সন্তানদের জন্য একটি সমৃদ্ধ দেশ।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayet-1@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.