মুদ্রানীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক কিছু

সরকারের অনেক নীতির মধ্যে একটি হচ্ছে মুদ্রানীতি। আগে এই নীতি এত আনুষ্ঠানিকতা করে ঘোষিত হতো না। এখন হয়- হয় বছরে দু’বার। একবার বাজেট ঘোষণার পর- জুলাই মাসে, আরেকবার জানুয়ারির দিকে। বাজেট হচ্ছে রাজস্বনীতি (ফিসক্যাল পলিসি) এবং সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিবৃতির সমাহার। রয়েছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি আর সেটা হচ্ছে বাণিজ্যনীতি (ট্রেড-ইমপোর্ট ও এক্সপোর্ট পলিসি)। বলা বাহুল্য, একটি আরেকটির পরিপূরক ও সম্পূরক। মনিটারি পলিসি, ফিসক্যাল পলিসি ও ট্রেড পলিসি একই উদ্দেশ্যে কাজ না করলে বিশেষ করে ঋণের টাকার সদ্ব্যবহার না হলে ফল লাভ করা যায় না। যেমন- ২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের হার ছিল ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ, অথচ জিডিপি সে বছর বৃদ্ধি পায় মাত্র সাড়ে ছয় শতাংশ হারে। পরের বছর বেসরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধি পায় ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। মজা হচ্ছে, সে বছরও জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ বেসরকারি ঋণ বৃদ্ধিতেও সাড়ে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে (২০১৪-১৫)। অতএব দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশি হলেই ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি বেশি হবে- এ কথার কোনো সঠিক ভিত্তি নেই। দরকার সব নীতির একমুখী বাস্তবায়ন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সবকিছু বাদ দিয়ে আমাদের মিডিয়া, আলোচক-সমালোচকরা বেসরকারি খাতে ‘ক্রেডিট’ কত এই নিরিখেই মনিটারি পলিসি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। দেখা যাচ্ছে,
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর ফজলে কবির ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি যথাবিহিতভাবে ঘোষণা করেছেন। নীতিতে বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণ বাড়বে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ, আর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। ‘রেপো’ (যে হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয়) রেট এবং রিভার্স রেপো (যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ধার দেয়) রেট যথাক্রমে ৬ দশমিক ৭৪৫ এবং ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ‘পলিসি’ রেট বলে পরিচিত রেটে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। যথারীতি ‘ব্রডমানি’ (কারেন্সি আউটসাইট ব্যাংকস যোগ তলবি আমানত যোগ মেয়াদি আমানত) এবং ‘ন্যারো মানি’র (ব্রডমানি বিয়োগ মেয়াদি আমানত) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই মুদ্রানীতিকে ‘সংযত’ মুদ্রানীতি, ‘সংকুলানমুখী’ মুদ্রানীতি, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ মুদ্রানীতি, পরিবেশবান্ধব মুদ্রানীতি, বিনিয়োগবান্ধব মুদ্রানীতি ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশেষ করে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা বেশ খুশি। কারণ বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দুই শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সরকারি খাতে ঋণ বাড়লে তারা খুশি হন না।
তারা মনে করেন এতে তাদের ভাগে কম পড়বে, যদিও বিদ্যমান বাস্তবতায় এর কোনো কারণ নেই। বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়লেই বিনিয়োগ বাড়বে, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে ইত্যাদি আশাবাদের যে বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই এ কথা প্রথমেই বলে ফেলেছি। আসলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে বা ভিন্নভাবে বললে বলতে হয় ব্যবসায়ীরা চান পর্যাপ্ত ঋণ, সময়মতো ঋণ এবং স্বল্পসুদে ঋণ। স্বল্পসুদে ঋণের দাবিই তাদের প্রবল। তারা চান স্বল্পসুদে ঋণ। ইতিমধ্যে তাদের দাবি মোতাবেক ব্যাংকগুলো ঋণের ওপর সুদের হার কমিয়েছে। কমিয়েছে বেশ ভালোভাবেই। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আরও কমার সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দুটো বিষয় বিবেচনায় নেয়া দরকার। প্রথমত. তাদের উৎপাদন খরচে ঋণের সুদের পরিমাণ কত এবং অন্যান্য খরচ কত। সুদ খরচ কমিয়েই কি তারা তাদের দক্ষতা বাড়াবেন, না অন্যান্য খরচের দক্ষতাও বৃদ্ধি করা দরকার? দ্বিতীয়ত. যারা আমানতকারী তাদের স্বার্থও কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত। তৃতীয়ত. শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহের বিকল্পের কথাও তাদের দীর্ঘমেয়াদে মনে রাখতে হবে। দৃশ্যত ঋণের ওপর সুদের হার বেশি বলে মনেই হয়। এর কারণ দুটো। মাত্রাতিরিক্ত কু-ঋণ বা শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণ (ক্ল্যাসিফায়েড লোন)। এটা কিন্তু ব্যবসায়ীদের কাছেই পাওনা। ব্যবসায়ীদের কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি,
কেউ ব্যবসায়িক কারণে খেলাপি। যেভাবেই হোক এর বোঝা কিন্তু ভালো গ্রাহকদের বেশি সুদ বহন করে পুষিয়ে দিতে হচ্ছে। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেলে ব্যবসায়ীরা আরও সস্তায় ঋণ পেতে পারতেন। এমনকি আমানতকারীরাও একটু বেশি সুদ পেতে পারতেন। কিন্তু তা হচ্ছে না। হাজার হাজার মামলা ঝুলে আছে। উচ্চতর আদালতে ‘রিট’ করে বহু মামলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সরকার অধিকসংখ্যক ‘বেঞ্চ’ এবং অধিকসংখ্যক বিচারক দেয়ার ব্যবস্থা করে এখন পর্যন্ত এ সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত সরকারকে তাগিদ দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা। আদালতে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার মামলা ঝুলে আছে। এর সমাধান হলে ব্যবসায়ীদের কম সুদে ঋণ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়, আমানতকারীও দুটো পয়সা বেশি পান। এ ব্যাপারে ‘এফবিসিসিআই’ কেন উদ্যোগী হবে না তাও আমি বুঝি না। সমস্যাটা ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে। ‘এফবিসিসিআই’য়ের সদস্যরা ঋণগ্রহীতা এবং আমানতকারীও বটে। তারা উদ্যোগ নিলে দেশবাসী উপকৃত হয়। মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে যে সংখ্যাতাত্ত্বিক চর্চা করা হয়েছে ওইসব বিষয়ে আমি কোনো আলোচনা করব না। যেমন- বেসরকারি খাতে এত শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধির কথা না বলে আরেকটু বেশি করার দরকার ছিল, অথবা কম করার দরকার ছিল- এসব বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।
কারণ আমি বিশ্বাস করি পরিমিত ঋণে। মাত্রাতিরিক্ত ঋণ কী ক্ষতি করে তা আমরা বর্তমান সরকারের প্রথম দিকে লক্ষ্য করেছি। আমি পূর্বাহ্নেই দেখিয়েছি বেশি বেসরকারি ঋণ দিলেই বিনিয়োগ তরতর করে বাড়বে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে তা সত্য নয়। বরং ঋণ ‘ডাইভার্ট’ হয়, ঋণের অপব্যবহার হয়, ঋণের টাকা পাচার হয়। এসব হলে ব্যাংকের যেমন ক্ষতি, তেমনি ক্ষতি গ্রাহকেরও। সস্তায় ঋণ পেয়ে অনেক গ্রাহক অবিবেচকের মতো অতিমুনাফার আশায় যেখানে-সেখানে বিনিয়োগ করে পরিণামে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর উদাহরণ বহু। জমি কেনা এর একটা উদাহরণ। আশার কথা গভর্নর ফজলে কবীর বলেছেন, তিনি ঋণ অপ্রয়োজনীয় খাতে, ঝুঁকিপূর্ণ খাতে যেতে দেবেন না। বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ুক- কিন্তু তা যেন উৎপাদনমূলক খাতে বাড়ে এটাই কাম্য। আরেকটি কথা। বড় বড় কর্পোরেট ঋণের বড় ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ দরকার। তাদের অনেকেই ‘ওভার বোরো’ করে ফেলেছে বলে দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অডিট ফার্ম দিয়ে একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার একটা বিহিত করা দরকার। যাতে যাদের দরকার তারা ঋণ পায়।
বিশেষ করে আমি বলব ছোট ও মাঝারিদের কথা। ব্যাংকে ব্যাংকে দশ, বিশ, পঞ্চাশ লাখ, এক-দুই কোটি, পাঁচ কোটি টাকার গ্রাহকের সংখ্যা হওয়া দরকার বেশি। কিন্তু এখানে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। বড় বড় ঋণের পরিমাণ মাত্রার বাইরে চলে গেছে। পুরো ব্যাংকিং খাত ভীষণ বড় ঝুঁকির মধ্যে। ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে কয়েকটি অঞ্চলে। এ প্রবণতা রোধ করা দরকার। ছোট ও মাঝারি ঋণের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। বড়দের উৎসাহিত করা দরকার শেয়ারবাজারে যেতে। এতে করে ব্যাংকিং খাতের বোঝা কিছুটা হ্রাস পাবে। খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট অঞ্চলে ঋণ যাচ্ছে না। এটা ভালো লক্ষণ নয়। মুদ্রানীতিতে এসব বিষয় স্থান পাওয়া উচিত। আরেকটি বিষয় বলা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক ভালো নীতি আছে। কিন্তু তা ব্যাংকগুলো বাস্তবায়িত করে না। না করলে তাদের কোনো শাস্তি হয় না। যেমন ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে যথেষ্ট নিয়ম-কানুন রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো তা হরেদরে অমান্য করছে। বিচার? বিচার নেই। মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের জন্য দরকার কঠোর ‘সুপারভিশন’ যার কথা গভর্নর বলেছেন। এর জন্য হাজার হজার ব্রাঞ্চ সুপারভিশন করার প্রয়োজনীয়তা কম। প্রত্যেক ব্যাংকের (৫৬টি ব্যাংক সর্বমোট) দশটি বড় ব্রাঞ্চ মনিটরিং করা হোক, সব বেরিয়ে আসবে। যেসব ব্রাঞ্চে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন হয়, যেসব ব্রাঞ্চে এলসি খোলা হয়,
সেসব ব্রাঞ্চ টার্গেট করে নামলে ফল পাওয়া যাবে। আগেই উল্লেখ করেছি শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে কাজ হবে না। মুদ্রানীতির দ্বারা ঋণের ব্যবস্থা হল, কিন্তু বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই, অবকাঠামোগত সুবিধা নেই, তাহলে কীভাবে হবে? ঋণ জোগানের সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ব্যবসায়ীদের দিতে হবে। জমি নেই দেশে। থাকলেও প্রচণ্ড দাম। দালিলিক সমস্যা। অতএব এসবের সমাধান না করে শুধু ঋণের ব্যবস্থা করে বিনিয়োগও বাড়ানো যাবে না, জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও বাড়ানো যাবে না। এবার অবশ্য একটা বাড়তি সমস্যা যোগ হয়েছে। যে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, কেনাবেচায় অর্থ জোগানের জন্য মুদ্রানীতি সেই ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে রফতানি ব্যবসা দারুণ হুমকির মুখে। এর কারণ নিরাপত্তাজনিত সমস্যা যা সৃষ্টি হয়েছে গুলশানের নারকীয় ঘটনার পর। বিদেশীদের হত্যাজনিত ঘটনার কারণে পোশাক খাতে একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এর সমাধান দরকার সর্বাগ্রে। এর সঙ্গে মুদ্রানীতি সম্পর্ক নেই। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান না হলে মুদ্রনীতি কোনো ফল দেবে না। পরিশেষে আমি মুদ্রানীতির সফলতা কামনা করি। শক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাকিং খাতের হাল ধরুক তা চাই। তারা যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারে তার নিশ্চয়তা চাই। দ্বৈত শাসনেরও অবসান চাই।
ড. আর এম দেবনাথ : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট; সাবেক শিক্ষক, ঢাবি

No comments

Powered by Blogger.