ছাত্রলীগকে সামলানোর দায়িত্ব কার?

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু হলের ভেতরে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী ও কবি নজরুল হলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট, সংগঠনটির এক পক্ষের কর্মীদের কাছে অপর পক্ষের কর্মীরা মোটেও নিরাপদ নন। এর একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, ইতিপূর্বে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ্ মখদুম (এসএম) হলে খাবারের টোকেন বিতরণকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সভাপতি (তৎকালীন) সমর্থিত কর্মীদের দ্বারা সাধারণ সম্পাদকের (তৎকালীন) সমর্থিত কর্মী নাছরুল্লাহ্ নাসিমকে মারধর করে শাহ্ মখদুম হলের দোতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়া এবং শেষ পর্যন্ত নাসিমের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে। ছাত্রলীগের উচ্ছৃংখল নেতাকর্মীদের দ্বারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার ফলে অনেক ছাত্রের প্রাণহানি ঘটাসহ অনেকে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন- ঠিক যেমনটি ঘটেছিল বিগত বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসীদের দ্বারা। আর এসব ঘটনায় বরাবরই যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়াসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু মূল্যবান সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সচেতন দেশবাসীর মনে থাকার কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট ঢাকাস্থ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে যখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংগঠন করার পাশাপাশি লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, ঠিক সেদিনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আর এতে কমপক্ষে ১৩ জন আহত হন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ শতাধিক রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছুড়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি ইতিপূর্বে বর্তমান সরকারের অনেক এমপি-মন্ত্রীও ছাত্রলীগকে দেশ ও জাতি গঠনে ভালো ভালো সব কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন, দিয়েছেন অনেক ভালো পরামর্শ এবং সর্বোপরি বারবার বলেছেন নীতি ও আদর্শের কথা। কিন্তু কে শোনে কার কথা? কীভাবে টাকা কামাই করা যাবে, কীভাবে প্রভাব বিস্তার করা যাবে সেইদিকে মন থাকায় এসব নীতিকথা ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীর (বিশেষ করে যারা মাইগ্র্যান্ট ছাত্রলীগ, সুযোগ সন্ধানী ও নিজ স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত) এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়। দলের মূল নেতৃত্ব থেকে ছাত্রলীগের প্রতি এসব আহ্বান জানানো ও পরামর্শ প্রদানের পাশাপাশি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারের পক্ষ হতে বলা হয়েছিল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে কেউ রেহাই পাবে না। বর্তমান সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও ইতিপূর্বে বলেছিলেন, ‘ছাত্র-রাজনীতির নামে গুণ্ডামি বন্ধ করতে হবে। এসব বন্ধ না করলে তিনি যে-ই হোন না কেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’। কিন্তু ছাত্রলীগের উদ্দেশে করা এতসব আহ্বান, পরামর্শ ও সতর্কতা জারি করার ফলাফল যে শেষ পর্যন্ত শূন্যের কোটায় গিয়েছে এবং বর্তমানেও যাচ্ছে তা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘ছাত্রলীগ’ নামধারী উচ্ছৃংখল নেতাকর্মীদের দ্বারা ‘কৃতকর্ম’ তথা বাস্তব অবস্থা দেখে সহজেই অনুমান করা যায়। একেই বুঝি বলে,
‘কথায় শুধু চিঁড়ে ভেজে না’। অনেক সময় দেখা যায়, ছাত্রলীগ নামধারী উচ্ছৃংখল নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার পর তাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরে এও দেখা যায়, বহিষ্কৃতদের ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়নের’ মতো আবারও সংগঠনে টেনে নেয়া হয় বা তারা তদবির করে সংগঠনে আবার স্থান পায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের বহিষ্কার করাটাই কি যথেষ্ট? ছাত্রলীগের উচ্ছৃংখল এসব নেতাকর্মীসহ ইতিপূর্বে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের যেসব সন্ত্রাসী শিক্ষাঙ্গনে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছিল; তাদের বিরুদ্ধে কি আইন অনুযায়ী শাস্তি হওয়া উচিত নয়? দেশ-জাতিসহ সবার বৃহত্তর স্বার্থেই তা হওয়া উচিত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সরকার কর্তৃক বিগত বছরগুলোতে দেশের অনেক উন্নয়ন-অগ্রগতি ও অর্জন হলেও তার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে দেশব্যাপী ‘ছাত্রলীগ’ নামধারী উচ্ছৃংখল কিছু নেতাকর্মীর বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে। আর ছাত্রলীগ নামধারীদের এ ধরনের সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দায় যে বর্তমান সরকারের ঘাড়েই পড়বে তা বলা বাহুল্য। তাই এ বিষয়টিকে অবশ্যই সরকারের অতি গুরুত্বসহকারে আমলে নেয়া উচিত। এর পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খুলে দিয়ে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা আবশ্যক। কারণ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেও ‘ছাত্রলীগ’ নামধারী এসব সন্ত্রাসী বারবার রেহাই পেয়ে যাচ্ছে এবং পুনরায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে।
এসব ঘটনার ফলে একদিকে যেমন দেশ-জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি শিক্ষাঙ্গনগুলোয় বারবার মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে লেখাপড়ার সুষ্ঠু-স্বাভাবিক পরিবেশ। সৃষ্টি হচ্ছে সেশনজট, শিক্ষার্থীদের পেছনে তাদের অভিভাবকদের ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। দেশের উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার, স্বার্থগত দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার কারণেই যে এসব সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটে চলছে তা সহজেই অনুমেয়। ইতিপূর্বে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ছাত্রদল ও শিবিরের নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগে ঢুকে পড়েছে।’ প্রধানমন্ত্রীর এ কথা যদি সত্য হয়, তবে তা হবে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা বাঁধারই নামান্তর। আর এ ক্ষেত্রে ঘোগ তাড়াতে নিশ্চয় বাঘকেই এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান সরকার বা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের তাদের নিজেদের স্বার্থেই তথা দলের স্বার্থেই এগিয়ে এসে ছাত্রলীগের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী ছাত্রশিবির কিংবা ছাত্রদলের চর বা সুবিধাভোগীদের বাছাই করে ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজানো উচিত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে দেশের সাধারণ মানুষ আজ রীতিমতো বিষিয়ে ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে- ঠিক যেমনটি বিষিয়ে ও অতিষ্ঠ হয়েছিল বিগত বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। এ যেন এ দেশের জনগণের জন্য ভাগ্যদেবীর এক ‘আশীর্বাদ’। বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটায় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা কি অপ্রতিরোধ্য? এসব সন্ত্রাসীকে কি সামলানো সম্ভব নয়? আর যদি সামলানো সম্ভব হয়, তাহলে সামলানোর দায়িত্ব কার? বর্তমান সরকারের নাকি অন্য কারও?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দ্বারা বারবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটলেও কেন তাদের সামলানো হচ্ছে না, এ প্রশ্ন তো খুবই যুক্তিসঙ্গত। আর এ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিরাই বা কী ভূমিকা পালন করছেন? বলা বাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে জ্ঞানের আধার। স্বাভাবিকভাবেই উচ্চশিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। পাশাপাশি মেধাভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে দেশ গঠন, জাতি ও সমাজ গঠনে তাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা। অতীতের ছাত্র রাজনীতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে ঠিক এমনই সব ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান ছাত্র রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। ছাত্র রাজনীতি করে যাদের দেশ ও জাতি গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা, আজ তারাই হত্যা, হামলা, ভাংচুর, হল দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা ধরনের অপতৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এর ফলে একদিকে যেমন তাদের মধ্য থেকে দেশগঠন ও জাতিগঠনের জন্য যোগ্য ও উপযুক্ত নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না, তেমনি এসব ঘটনার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলেরই একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করা দরকার, কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন কর্তৃক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটানো হলে সেই সংগঠনের ভাবমূর্তি বিশেষভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। তাছাড়া পরবর্তী সময় সরকার গঠনে বা নির্বাচনে ওই রাজনৈতিক দলের ওপর এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বর্তমান সরকারসহ সব রাজনৈতিক সংগঠনেরই উচিত হবে দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা। এ ব্যাপারে যদি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন সম্মিলিতভাবে ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয়, তবে তা হবে সবার জন্যই মঙ্গলজনক। বর্তমান সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সম্মিলিতভাবে ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে- এমনটাই সবার প্রত্যাশা। সর্বোপরি, এ কথা সবারই ভালোভাবে স্মরণে রাখা প্রয়োজন, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জনসহ অবৈধ নানা সুযোগ-সুবিধা অর্জনের পথ বন্ধ না করলে শুধু নীতি কথায় বা পরামর্শে কোনো কাজ হবে না।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা; অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য
kekbabu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.