আমাদের অর্থনীতির জিয়নকাঠি

সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকসহ সব ধরনের কর্মী নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। সাত বছর আগে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। পরবর্তী সময়ে নারী গৃহকর্মীদের জন্য সৌদি শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয় আংশিকভাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের পর দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে আবার সব ধরনের কর্মী নেয়ার বিষয়টি সামনে আসে। আশা করা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়ায় সৌদি আরবে বাংলাদেশী জনশক্তি রফতানির বিশাল বাজার শিগগিরই উন্মুক্ত হবে। বর্তমানে সেদেশে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকের সংখ্যা ১৩ লাখ। এর মধ্যে ৬০ হাজার নারী শ্রমিকও রয়েছেন। ২০০৮ সালের আগে গড়ে প্রতি বছর এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশী সৌদি আরবে নিয়োগ পেত। নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠিয়ে নেয়ায় সেই সুদিন আবার ফিরে আসবে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক, নির্মাণকর্মী, চিকিৎসক, নার্স, শিক্ষক, কৃষকসহ সব ধরনের কর্মীর সৌদি আরবে কাজ পাওয়ার পথ সুগম হবে। তবে তেলের দামে ধস নামা এবং নানা অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সুফল কতটা পাওয়া যাবে তা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। সৌদি আরবে বাংলাদেশী জনশক্তি রফতানি বন্ধের পেছনে রিক্রুটিং এজেন্টদের অসততা, প্রবাসী কর্মীদের একাংশের শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগ অংশত দায়ী।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর অসৎ রিক্রুট এজেন্টদের অপতৎপরতা যাতে মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। জনশক্তি পাঠানো আবার শুরু হলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সরকারের মনিটরিং জোরদার করতে হবে। অদক্ষ শ্রমিকের বদলে দক্ষ শ্রমিক ও উচ্চ পেশার লোকদের যাতে বেশি সংখ্যায় পাঠানো যায় সে বিষয়ে উদ্যোগ ও প্রস্তুতি নেয়া দরকার। একথা ঠিক, প্রত্যেক মানুষই তার দেশের জন্য সম্পদ। কারণ মানুষের শ্রম ও মেধায় একটি দেশ বা জাতির অগ্রগতি নিশ্চিত হয়। আমাদের দেশের অভ্যন্তরে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাই গুরুত্ব বেড়েছে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার। কারণ একজন দক্ষ-প্রশিক্ষিত মানুষ আত্মকর্মসংস্থানের পথটাও নিজেরাই অনেকটা বাতলে দিতে পারেন, যদি যথাযথ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য মেলে। শিক্ষিত কিংবা দক্ষ জনশক্তি একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে নানাভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। নৈতিক মূল্যবোধের যে অবক্ষয় এ সমাজে ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে, এ থেকে মুক্তির লক্ষ্যেও এর গুরুত্ব অনেক বেশি। সমাজ আলোকিত হয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও জ্ঞানী মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। শুধু দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রয়োজনেই নয়, বর্তমান বিকাশমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। উদ্ভাবনী শক্তি ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ নানা ক্ষেত্রে শিক্ষিতদের হাত ধরেই দেশ-জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, মানসম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণের পথ কুসুমাস্তীর্ণ করা, একই সঙ্গে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের পথ প্রশস্ত করা। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় শিক্ষিত ও দক্ষদের কদর ক্রমেই বাড়ছে। সব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের দ্বার অবারিত করা যাবে এমনটি সহজ না হলেও শিক্ষিত ও দক্ষরা যাতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ করতে পারেন, এ বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কর্মক্ষম কিংবা সৃজনশীলরা যাতে অলস পড়ে না থাকেন, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।
বিপুল সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যেসব কারণে এখানে এগিয়ে যাওয়ার নানা প্রতিকূলতা প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাও ভেঙে ফেলতে হবে। সরকারের একার পক্ষে জনশক্তি রফতানি বাড়ানো কঠিন। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতিও সর্বজনবিদিত। জনশক্তি রফতানি মুখ থুবড়ে পড়ার পেছনে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতিরও দায় রয়েছে। সুষ্ঠু প্রক্রিয়া মেনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এলে সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বুঝতে হবে, কোনো কারণে জনশক্তি রফতানি বিঘ্ন হলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিশেষে বলছি, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও জনশক্তি রফতানির কথা মাথায় রেখে পররাষ্ট্র সম্পর্ক নির্ধারণে উদ্যোগী হতে হবে। জনশক্তি রফতানির ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যাপকভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা ও শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জিয়নকাঠি। এ জিয়নকাঠিকে সজীব রাখতে আরও বেশি পরিচর্যার বিষয়টি গুরুত্বের দাবিদার। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। আমরা আশা করব, কর্মী নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার মুসলিম উম্মাহর দুই ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ককে আরও জোরদার করতেও সহায়তা করবে।
ইফতেখার আহমেদ টিপু : একটি বাণিজ্যিক গ্রুপের চেয়ারম্যান
chairman@ifadgroup.com

No comments

Powered by Blogger.