আমাদের আইভি আপা

দেখতে দেখতে একযুগ হয়ে গেল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। মরহুম আইভি রহমানের কথা বলছি, যিনি ছিলেন একাধারে রাজনীতিক, সমাজসেবী, নারীনেত্রী ও গৃহিণী। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা সম্পাদিকা, মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, মহিলা সমিতির সভানেত্রী, জাতীয় মহিলা সংস্থার সভানেত্রী এবং দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ন্যাশনাল সোসাইটি ফর দ্য ব্লাইন্ডের (বিএনএসবি) সাধারণ সম্পাদিকা। ব্যক্তিজীবনে বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী। স্বাধীনতা আন্দোলন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সেবামূলক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ, নারীদের কর্মসংস্থান, রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন আন্দোলনে আইভি রহমানের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার সঙ্গে তার সরাসরি পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ১৯৮২ সাল থেকে। তখন তিনি বিএনএসবির সাধারণ সম্পাদিকা এবং আমি একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তার সঙ্গে আমার কত দিনের কত স্মৃতি! তখন তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরে ইকবাল রোডের বাসায় থাকতেন। একদিন তার বাসায় গিয়েছি। দোতলার ড্রয়িংরুমের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর এক বিশাল প্রতিকৃতি টানানো। বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তন্ময় হয়েছিলাম।
আর মনে পড়ছিল এ মহান নেতার সঙ্গে আমার ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের প্রথমদিকের কিছু ঘটনার কথা। হঠাৎ আপার কণ্ঠস্বরে সম্বিত ফিরে পেলাম। আমাকে উদ্দেশ করে আইভি আপা বলছেন, ‘আনোয়ার সাহেব, ১৯৭৪ কী ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু একদিন আমাকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে এ ছবিটি দিয়ে বলেছিলেন, আইভি এ ছবিটি তোকে দিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে এ ছবিটি কেন দিয়েছিলেন- আমি আজও তা জানি না।’ সেদিন আপার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক কথা হয়। বঙ্গবন্ধুর কথা, রাজনীতির কথা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কীভাবে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বিএনএসবি গঠন করার উদ্যোগ নিলেন- সে কথা। এরই মাঝে তিনি নিজে উঠে গিয়ে বাসার ভেতর থেকে আমার জন্য মাছের কোপ্তা এনে খেতে দিলেন। তারপর থেকে আইভি আপার তথা জিল্লুর রহমানের (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) বাসা ছিল আমার জন্য অবারিত দ্বার। পরবর্তী সময়ে তাদের গুলশানের বাড়িতে গিয়েছি বহুবার- কোনোদিন ড্রয়িং রুমে, কোনোদিন ডেকে নিতেন একেবারে ভেতরের রুমে। অনেক স্নেহ করতেন ছোটভাইয়ের মতো। তখন গুলশানের বাড়িটি ছিল একতলা। চতুর্দিকে খোলা জায়গা। আমগাছ ও ডালিমগাছসহ ছোট ছোট অনেক গাছপালা। সামনে পূর্বদিকের অংশে বিশাল লন। সেখানে মাঝে মধ্যে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। অপূর্ব সুন্দর লাগত বাড়িটি।
পরে ওই স্থানে সম্পূর্ণ জায়গায় আইভি আপার জীবদ্দশায়ই নির্মিত হয় বহুতল ভবন ‘আইভি লিগাসি’। সেখানেও আপার সঙ্গে কয়েকবার গিয়েছি। বিশাল বিশাল এক-একটা রুম। ড্রয়িং, ডাইনিং, বেড; কিন্তু এখনও আগের সেই একতলা খোলামেলা সুন্দর বাড়িটি সবসময় আমার চোখে ভাসে। প্রতি বছর আপার মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদে অংশ নিতে গুলশানে ‘আইভি লিগাসি’তে যাই; কিন্তু সেই একতলা বাড়িটির সৌন্দর্য যেন আর খুঁজে পাই না। বাড়িটি গুলশান লেকের পশ্চিমে এবং আমার বাসা লেকের পূর্ব পাড়ে বিধায় (হাঁটা পথে ৫ মিনিটের পথ) বিভিন্ন স্থানে যাওয়া-আসার সময় প্রায়ই এ বাসার পাশ দিয়ে যেতে হয়। স্বভাবতই বাসার দিকে তাকাই। মনে পড়ে কত দিনের কত স্মৃতি। জিল্লুর রহমান যখন মন্ত্রী হলেন তখন মন্ত্রীপাড়ার সরকারি বাড়িতে উঠলেন। হেয়ার রোডের বিশাল দোতলা বাড়ি। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও মন্ত্রীর সেই বাড়িতে যেতে আমাদের জন্য কোনো অনুমতি লাগত না বা ঢোকার সময় আমাদের জন্য কোনো রকম চেকিংও ছিল না। কারণ আইভি আপার অনুমতি পেয়ে তল্লাশির পর যারা ভেতরে ঢুকত তাদের দেখেছি নিচতলায় ড্রয়িংরুমে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে; কিন্তু আমরা সরাসরি দোতলায় চলে যেতাম। কারণ আমরা আইভি আপার লোক। সেই মন্ত্রীপাড়ার বাড়িতে ঢুকে নিচতলার ড্রেয়িংরুম বাঁয়ে রেখে এগিয়ে গেলে ডান দিকে মোড় ঘুরে মন্ত্রীর পিএসের রুম। তারপর মাননীয় মন্ত্রীর নিজের বসার রুম। এসব রুমের ভেতর দিয়ে যেতে হতো দোতলায় আপার ড্রয়িংরুমে।
প্রায় দিনই উপরে যাওয়ার পথে মন্ত্রী মহোদয়ের বসার রুমে ঢুকে তাকে (জিল্লুর রহমান) পেয়েছি। তিনি হাসিমুখে বলতেন ‘উপরে যাও- আইভি আছে’। সেসব স্মৃতি মনে পড়লে এখনও চোখে পানি আসে। জিল্লুর রহমান যখন রাষ্ট্রপতি তখন বঙ্গভবনে (রাষ্ট্রপতির সরকারি ভবন) যেতাম আইভি আপার মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদে। লুৎফর ভাই কার্ড পাঠাতেন। লুৎফর রহমান। জিল্লুর রহমানের ছোটভাই (কাজিন)। সবসময় ছায়ার মতো থাকতেন তার ভাই ও ভাবীর সঙ্গে। সদা-সর্বদা নিয়োজিত থাকতেন তাদের ভালো-মন্দে। ভাই, ভাবী ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। আমাদের সেই লুৎফর ভাই থাকেন কলাবাগানে নিজ বাড়িতে। এখনও আমার আপনজন। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের এক শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৪৪ সালে আপার জন্ম। জিল্লুর রহমান, আইভি আপা ও লুৎফর ভাইয়ের সঙ্গে ২ থেকে ৩ বার গিয়েছি ভৈরবে তাদের বাড়িতে। আইভি আপার পিতা জালালউদ্দিন ছিলেন ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল। জিল্লুর রহমান ছিলেন সম্পর্কে আইভি আপার চাচাত ভাই। তার সঙ্গে আপার যখন বিয়ে হয় আপা তখনও স্কুলছাত্রী। তাদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে- পাপন, তানিয়া ও ময়না। এখন তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত। পাপন (নাজমুল হাসান) বর্তমানে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে নির্বাচিত (আওয়ামী লীগদলীয়) সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। আইভি আপা ও জিল্লুর রহমান দম্পতি সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে ওয়ারীর বাসায় থাকতেন। জজ কোর্টের তৎকালীন পিপি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের (সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি)
পরিবার একই বাসার (উপর ও নিচ তলায়) থাকার সুবাদে দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আইভি রহমান বাংলাদেশ ন্যাশনাল সোসাইটি ফর দ্য ব্লাইড (বিএনএসবি) গঠন করেন। খন্দকার মাহবুব হোসেন সভাপতি এবং আইভি রহমান সাধারণ সম্পাদিকা। সেই থেকে (মাঝখানে কয়েক বছর বাদ দিয়ে) তারা দু’জন চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে বিএনএসবির হাল ধরে রাখেন। আইভি আপার আকস্মিক মৃত্যুর পরও খন্দকার মাহবুব হোসেন এখন পর্যন্ত বিএনএসবি’র হাল ধরে আছেন। আইভি রহমানের আর এক সহকর্মী খালেদা খানমসহ আরও অনেককে নিয়ে। তিনি সভাপতি ও খালেদা আপা সাধারণ সম্পাদিকা এবং লুৎফর ভাই কার্যনির্বাহী কমিটির একজন প্রবীণ সদস্য। আইভি রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে বিএনএসবি পরিচালিত মিরপুরের ‘ঢাকা চক্ষু হাসপাতালের’ মহিলা ওয়ার্ড। সেখানে বড় করে নামফলক লাগানো আছে-‘আইভি রহমান মহিলা ওয়ার্ড’। পাশেই আইভি আপার প্রতিকৃতি। আমরা প্রতি বছর আইভি আপার মৃত্যুবার্ষিকীতে বিএনএসবির পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, সাধারণ সম্পাদিকা খালেদা খানম, ভাইস চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদীন, প্রবীণ সদস্য লুৎফর রহমান এবং আমার সহকর্মী মোহাম্মাদ আলী, খন্দকার মহিদুল ইসলাম মোর্শেদ, নাসির আহমেদ, আরিফুর রহমান সজীব, শেখ মোস্তফাসহ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে তার বনানীর কবরস্থানে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করি এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। মহিলা আওয়ামী লীগ, মহিলা সমিতি, দৈনিক গৃহকোণ পরিবারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রতি বছর ২৪ আগস্ট পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ বছর তার মৃত্যুবার্ষিকী সামনে রেখে মহান আল্লাহর কাছে তার বিদেহী আত্মার শান্তি ও মঙ্গল কামনা করছি।
আনোয়ার হোসেন : পরিচালক, বিএনএসবি ঢাকা চক্ষু হাসপাতাল

No comments

Powered by Blogger.