ভয়, অন্ধকার ও বিভ্রান্তি কাটুক

গুলশান-বনানী এলাকার ভুতুড়ে ভাব এখনো কাটেনি। ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে যে রক্তকাণ্ড ঘটেছে, তার এমন প্রতিক্রিয়াই তো স্বাভাবিক। এই বর্বরতা আমাদের সবাইকে বিধ্বস্ত ও বিমূঢ় করেছে। রাত আট-নয়টার পরেই এখন রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। আমাদের সবার মনে ভয় ঢুকেছে, আর আমরা ঢুকে গেছি ঘরে। ওই ঘটনার পর এখন দেখছি মাঝেমধ্যেই নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ হঠাৎ শহরজুড়েই এর প্রভাব চোখে পড়ে। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর নিরাপত্তা ও সতর্কতাকে এখন অবশ্যই এক নম্বরে জায়গা দিতে হবে, তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা ও স্বাভাবিক করার বিষয়টিও কম জরুরি নয়। গুলশান-বনানী এলাকায় এমন অনেক দোকানপাট ও রেস্তোরাঁ ছিল, যেগুলো বেশ রাত পর্যন্ত খোলা থাকত। গত সোমবার, ঢাকা হামলার ১৮ দিনের মাথায় রাত ১১টার পর গুলশানে কোনো রেস্তোরাঁ খোলা পাওয়া গেল না। বেশি রাত পর্যন্ত খোলা থাকে এমন একটি রেস্তোরাঁর সামনে গিয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘ওই ঘটনার পর থেকে আমরা ১১টার মধ্যে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিই।’ আর বন্ধ না করেই বা উপায় কী, খদ্দের থাকলে তো রেস্তোরাঁ খোলা রাখবে!
রেস্তোরাঁ নাহয় বন্ধ, কিন্তু রাস্তার বাতিগুলোর এই দশা কেন? এলাকাজুড়ে কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার ভাব। কম আলো অথবা কোথাও কোথাও বাতির অভাব পুরো পরিবেশের মধ্যে একটা ছমছমে ভাব তৈরি করেছে। অন্ধকার ভয় ছড়ায়, ওই এলাকায় কি একটু আলো বাড়ানো যায় না? টিমটিমে বা নষ্ট বাতিগুলোকে কি বদলানো যায় না? বা বাতির সংখ্যা বাড়ানো? নিরাপত্তার জন্যও তো এটা জরুরি। এমন কম আলো আর অন্ধকারে সিসি ক্যামেরায় যা ধরা পড়ে, তা তো খুব কাজে দেওয়ার কথা না। সেখানকার মেয়র আনিসুল হকের চিন্তাভাবনায় কী আছে কে জানে! আমরা চাই আলো ও বাড়তি আলোর বিষয়টি তাঁর নজরে ও বিবেচনার মধ্যে আসুক। দেখা যাক তিনি কী করেন। ঢাকা ও শোলাকিয়ায় পরপর দুটি হামলার ঘটনার পর ফ্রান্সের নিসেও ঘটল ভয়ংকর কায়দায় মানুষ খুনের ঘটনা। প্যারিসে এর আগেও দুটি বড় হামলা হয়েছে, রক্ত ঝরেছে। বাস্তবতা মেনে নিয়ে দেশটি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ বলেছেন, ফরাসি জনগণকে হয়তো সামনে এর মধ্যেই বসবাস করতে হবে। বুঝতে পারছি, আমরাও একই পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। আমাদের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে।
সতর্ক নিশ্চয়ই আমাদের থাকতে হবে। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যেমন বাড়তি উদ্যোগ লাগবে, তেমনি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তৎপরও হতে হবে। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যেই জীবনযাপনে আমাদের স্বাভাবিক দশায় ফিরতে হবে। দমবন্ধ ভাব থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। সেটা করতে না পারলে হামলাকারীরাই যে সফল হিসেবে বিবেচিত হবে! কারণ, তারা তো আমাদের মধ্যে ভয়ই ছড়াতে চায়। তারা ভয় দেখিয়ে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে দূরে রাখতে চায়।
ফ্রান্সের নিসে হামলার এক সপ্তাহও পার হয়নি। গণমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে, সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এপি খবর দিয়েছে, নিসের বিখ্যাত রিভেরা উপকূলে লোকজন আবার জগিং শুরু করেছে, বাইসাইকেলওয়ালারা রাস্তায় নেমেছে, রোদ পোহানোরা ফিরে এসেছে। খুলছে খাবারের দোকানগুলো। সেখানে জীবন স্বাভাবিক হওয়ার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। সিএনএনের প্রতিবেদক লিখেছেন, শহরটি জেগে উঠছে, আগের রাতের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। আমাদেরও সেই পথেই হাঁটতে হবে। কিন্তু সেখানে সম্ভবত আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। গুলশান হামলার পর নিরাপত্তা বাড়িয়ে যখন সেখানকার পরিস্থিতি যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তখন আমরা দেখছি সরকার নেমেছে ওই এলাকা থেকে ‘অবৈধ’ হোটেল রেস্তোরাঁ উচ্ছেদে। মনে হচ্ছে দেশে জঙ্গিবাদের বিপদ আর বিস্তারের সব দায় যেন গুলশান-বনানীর এই রেস্তোরাঁগুলোর। এই রেস্তোরাঁগুলো এক দিনে হয়নি, এখন তা সরাতে হলে বাস্তবতা বিবেচনায় নিতে হবে ও একটি দীর্ঘ পরিকল্পনার ভিত্তিতে করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি গুলশানে হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও সব ঝাল ঝাড়া হচ্ছে সেখানকার রেস্তোরাঁগুলোর ওপর!
গুলশান হামলার পর কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা নিশ্চয়ই দরকারি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেখানে যদি বিদেশিদের জন্য নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়, তবে তঁাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাটিও তো বিবেচনায় রাখতে হবে। আমরা চাই বিদেশিরা আমাদের দেশে আসুন, এখানে তাঁদের জীবনযাপনে নিরাপত্তা ও স্বচ্ছন্দ থাকুক। আমাদের দেশে সন্ধ্যার পর রেস্তোরাঁয় যাওয়া ছাড়া আর কীই-বা বিনোদনের ব্যবস্থা আছে বিদেশিদের জন্য? তাঁদের নিরাপত্তার জন্য সেই এলাকা থেকে যদি রেস্তোরাঁ সরিয়ে দেওয়া হয়, তবে তাঁরা খাবেন কোথায়? খাওয়ার জন্য কূটনৈতিক জোনের বাইরে বের হতে হলে তাঁদের বাড়তি বিপদে ঠেলে দেওয়া হবে না তো! গুলশানের হামলা আমাদের এক নতুন বাস্তবতার মধ্যে ফেলেছে। এই বাস্তবতা মোকাবিলার কৌশল তাই চিন্তাভাবনা করেই নিতে হবে, প্রতিক্রিয়ামূলক যেকোনো উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল কাজ হিসেবেই বিবেচিত হয়। সন্ত্রাসের সঙ্গে বসবাস বা সামনে নতুন কোনো বিপদের আশঙ্কার মধ্যেও আমাদের হলি আর্টিজান বা শোলাকিয়ার দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে হবে। রবীন্দ্রনাথকে এখানেও আমরা স্মরণ করতে পারি—
‘আমি ভয় করব না ভয় করব না।
দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না॥
তরীখানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে—
তাই ব’লে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরব না, কান্নাকাটি ধরব না॥’
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.