উৎসবের রাতে মৃত্যুর বিভীষিকা

হামলায় প্রিয়জন হারানো এক যুবক কান্নায় ভেঙে পড়েন -এএফপি
আনন্দের উৎসবে আতশবাজির ঝলমলে প্রদর্শনী, উচ্চলয়ের সঙ্গীত আর আনন্দমুখরতায় মেতে ছিল হাজার হাজার জনতা। হঠাৎ জনতার ভিড়ের মধ্যে ধেয়ে এল বিশাল এক সাদা ট্রাক। চাপা দিল ৮৪টি তাজা প্রাণ। নিমিষেই আনন্দের মধ্যে নেমে এলো বিভীষিকা। বাস্তিল উৎসব পরিণত হল মৃত্যুপুরীতে। ফ্রান্সের নিস শহরের ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বিখ্যাত প্রমেনাদে দেজ অ্যাংলেইস পরিণত হল আতংকের চত্বরে। শোকের মাতমে ছেয়ে গেল ফ্রান্সের আকাশ-বাতাস। বৃহস্পতিবার রাতে ফ্রান্সের নিসনগরে বাস্তিল দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আতশবাজির উৎসব চলাকালীন এক চালক একটি ভারি ট্রাক দ্রুতগতিতে জনতার ওপর তুলে দেয়। সাগর সৈকতের কাছে ওই অবকাশযাপন কেন্দ্রের প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত ট্রাকটি টেনে নিয়ে যায় চালক। এতে এখন পর্যন্ত ৮৪ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। খবর এএফপির। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা সেই মুহূর্তের ছবি আর ভিডিওতে ফুটে উঠেছে হামলার ভয়াবহতা।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় একটি বার্তা সংস্থাকে জানান, ওই ট্রাক মানুষকে পিষতে পিষতে অগ্রসর হচ্ছিল, চারদিকে ছিটকে পড়ছিল মানুষ। এ হামলা যখন ঘটে হাজার হাজার নারী- পুরুষ ও শিশু তখন সঙ্গীতমুখর পামগাছে শোভিত চত্বর ধরে হাঁটছিলেন বিখ্যাত নেগ্রেসকো হোটেলের দিকে। ইউটিউবে আসা এক ভিডিওতে দেখা যায়, ২৫ টনি ওই ট্রাক হামলে পড়ার পর বাদ্য-বাজনা ছাপিয়ে পুরো এলাকা ভরে ওঠে আতংকিত মানুষের চিৎকার; সাহায্যের আশায় দিগি¦দিক ছুটতে শুরু করেন সবাই। প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি ফ্রান্স ইনফোকে বলেন, তিনি গুলির শব্দও শুনেছেন। প্রথমে আতশবাজির শব্দ মনে করলেও পরে তীব্র আতংক ছড়িয়ে পড়ে। তিনিও অন্যদের মতো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়াতে থাকেন। স্থানীয় বিএফএম টিভিকে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, সবাই চিৎকার করছিল আর বলছিল হামলা হয়েছে। আমরা গুলির শব্দও শুনি। তবে ভেবেছিলাম, সেগুলো আতশবাজির শব্দ। স্থানীয় আরেকজন জানান, হঠাৎ ট্রাকের গতি কমে আসে।
পরে বুঝলাম পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। সাড়ে তিন লাখ অধিবাসীর শহর নিস পর্যটন ও জাঁকজমকপূর্ণ রিসোর্টের জন্য বিখ্যাত। গতবছর ইসলামিক স্টেটের হামলার পর ফ্রান্সের দিবস ও বড় জমায়েতগুলোতে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছিল। তবে নিসের ওই চত্বরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিছু সময় শিথিল ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। ‘বাস্তিল দিবস’ কী? : ‘বাস্তিল ডে’ বা ফ্রান্সের জাতীয় উৎসবের দিনে দেশটির নিস শহরে এক সন্দেহভাজন জঙ্গি ট্রাক হামলা চালায়। এতে অন্তত ৮৪ জন নিহত হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে উৎসব পালনের জন্য নারী-শিশুদের নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে আসেন ঠিক তখনই বিশালাকার একটি লরি নিয়ে রাস্তায় এসব মানুষকে পিষে মারে। এটি কার্যত ফরাসিদের স্বাধীনতা দিবস। এটি ‘বাস্তিল উৎসব’ হিসেবে পরিচিত। ফরাসিদের কাছে এটি ‘লা ফিতি ন্যাশনালী’ উৎসব নামেই বেশি পরিচিত। স্থানীয়ভাবে এটি ‘লে কুয়াতার্জি জুইলেট’ (ফরাসি ভাষায় ১৪ই জুলাই) নামে পরিচিত।
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদে বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটে। এ দিনকে স্মরণ করে প্রতি বছরের ওই দিনে জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে এটি উদযাপিত হয়। বাস্তিল দুর্গ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক। এরপর থেকেই ফরাসিরা এই দিনটিকে জাতীয় উৎসব হিসেবে পালন করে আসছে। ১৭৯০ সালে প্রথম ‘বাস্তিল ডে’ উদযাপন করা হয়। এ দিন ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতির সম্মুখে প্যারিসের শজেলিজে এভিনিউতে দেশটির বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ক্যাডেটদের কুচকাওয়াজ, সাধারণ সৈন্যদের কুচকাওয়াজ, সাঁজোয়া গাড়ির বহর ইত্যাদি চলতে থাকে। ওপরে আকাশে চলে বিমান। সম্প্রতি ফ্রান্সের মিত্র দেশের সৈন্যরাও এই কুচকাওয়াজে অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ পান। এই দিন ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি সাধারণত দেশের অবস্থা সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকার দেন এবং ছোটখাটো অপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা রেন।
হামলার পর আইএস সমর্থকদের উল্লাস
ফ্রান্সের ট্রাক হামলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লাস প্রকাশ করেছে আইএস সমর্থকরা। ঐতিহাসিক বাস্তিল দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী নিস শহরে এক আতশবাজি প্রদর্শনী দেখতে জড়ো হওয়া মানুষের ওপর ট্রাক চালিয়ে এ হামলা করা হয়। এতে অন্তত ৮৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও শতাধিক। খবর ডেইলি মেইলের। এই হামলায় উল্লাস প্রকাশ করে এক আইএস সমর্থক টুইট করেছে, ‘ফ্রান্সের নিস শহরে নিহত ক্রুসেডার ও অবিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়ছে। আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান।’ এসব আইএস সর্মথক ফ্রান্সবিরোধী ছবি ব্যবহার করে টুইটারে হ্যাশট্যাগ দিচ্ছে। এ ছাড়া ফ্রান্সকে হুশিয়ারি করে তারা ‘নিস অ্যাটক’ হ্যশট্যাগও ব্যবহার করছে। এ ঘটনার দায় আইএস স্বীকার করে নিয়েছে বলে জানিয়েছে ফরাসি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন প্যারিস ম্যাচ। তবে ওই সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, আনুষ্ঠানিকভাবে দায় স্বীকার করেনি আইএস জঙ্গিগোষ্ঠী।

No comments

Powered by Blogger.