শান্তি আন্দোলনের নেতা আলী আকসাদ by জেসমিনা শান্তা

আলী আকসাদ
আজ পয়লা মে, বিশ্বশান্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব আলী আকসাদের ৮৪তম জন্মবার্ষিকী। সৌভাগ্যক্রমে আমি তাঁর মেয়ে। জন্মজয়ন্তীতে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তিনি তাঁর কাজের জায়গাটি প্রসারিত করেছিলেন এবং জনগণের ভালোবাসা পেয়েছিলেন। সততা, নির্ভীকতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাঁকে করে তুলেছিল বিশেষ এক বামপন্থী রাজনীতিবিদ। কিশোর বয়সেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার কারণে রাজবন্দী হিসেবে আলী আকসাদকে কারাগারে যেতে হয়। দুই পর্যায়ে মোট আট বছর তিনি জেল খাটেন। জেলখানায় থেকেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কমিউনিস্ট নেতা সরদার ফজলুল করিম ও অনিল মুখার্জির কাছ থেকে তিনি দর্শনের কঠিন অধ্যায়গুলো আত্মস্থ করেন।  বাবা হিসেবেও তিনি অনবদ্য। পেশাগত জীবনে আলী আকসাদ ছিলেন সাংবাদিক। তিনি দীর্ঘদিন ইত্তেফাক-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সংবাদ-এ তিনি ছিলেন বার্তা সম্পাদক। সংবাদ-এ তাঁর রাজনৈতিক কলাম ‘দীপঙ্কর’ জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে মোনায়েম খানের প্ররোচনায় যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, তার বিরুদ্ধে সাংবাদিকেরা সোচ্চার হন। ইত্তেফাক অফিসে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আলী আকসাদ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাঁরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। সরকার নয়জন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও তাঁদের আটক করে। আইয়ুব খানের শাসনামলে শহীদুল্লা কায়সার, আলী আকসাদসহ অনেক বুদ্ধিজীবী ও বামপন্থী নেতাকে আটক করা হয়। এ পর্বে আলী আকসাদ দুই বছর জেলখানায় ছিলেন। আলী আকসাদ পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে বেগম সুফিয়া কামাল ও প্রফেসর মুহম্মদ হবিবুল্লাহর নেতৃত্বে পাকিস্তান সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং আন্তর্জাতিক মৈত্রী ও সংহতি আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন। সে বছরই তিনি আতাউর রহমান খানের সঙ্গে সোভিয়েত পাকিস্তান মৈত্রী সংস্থার আমন্ত্রণে প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আলী আকসাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে দেশ যখন বিপন্ন, তখন আলী আকসাদ বিশ্বশান্তি পরিষদে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি তুলে ধরেন। তৎকালীন বিশ্বশান্তি পরিষদের (ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল) মহাসচিব ছিলেন শ্রী রমেশ চন্দ্র। আলী আকসাদ যুদ্ধপীড়িত জাতির জন্য আন্তর্জাতিক সংহতি, সমর্থন ও সাহায্য লাভে সচেষ্ট থাকেন। ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ঘোষণার দিনে তিনি বেসরকারি প্রতিনিধি হিসেবে প্রথম মস্কোয় যান। স্বাধীনতার পর আলী আকসাদ বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতি এবং ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বের দরবারে একজন শান্তিকামী নেতা হিসেবে তুলে ​ধরতে উদ্যোগ নেন এবং বিশ্ব শান্তি পরিষদে তঁাকে জুলিও কুরি মেডেল দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করা হয়। এ উপ​লক্ষে অায়ে​াজিত সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন আলী আকসাদ। বহু দেশি-বিদেশি গুণীজনের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে সোনার মেডেলটি পরিয়ে দেন বিশ্বশান্তি পরিষদের মহাসচিব শ্রী রমেশ চন্দ্র। পাশেই ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল আলী আকসাদ। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। শেখ মুজিবুর রহমান পেলেন জুলিও কুরি শান্তি পদক। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনটিতে যুক্তর​াষ্ট্রের অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী ডিন রিড প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আলী আকসাদ ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে দেশের ভেতরে ও বাইরে জনমত গড়ে তোলেন। আশির দশকে ঢাকায় দায়িত্বরত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত আহমেদ রাজ্জাক ছিলেন তাঁর বন্ধু। ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। ইয়াসির আরাফাতের সই করা ডায়েরি এখনো আমাদের বাসায় আছে। এ সময় ঢাকায় ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বহু সভা হয়। আলী আকসাদ শান্তি আন্দোলন করতে গিয়ে বহু বিশ্ববরেণ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। সারা জীবন তিনি দেশে গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ছিলেন। ৬ মার্চ ২০০৯ সালে তিনি মারা যান। তাঁর  জীবন-দর্শন আমাদের নিয়ত অনুপ্রাণিত করে।
জেসমিনা শান্তা: আলী আকসাদের মেয়ে। নির্বাহী সদস্য বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ।
jshanta @gmail.com

No comments

Powered by Blogger.