কেন সিরিয়া ছাড়লেন পুতিন by জোনাথন স্টিল

ভ্লাদিমির পুতিন যে সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতে হোয়াইট হাউস থেকে শুরু করে বাশার পর্যন্ত সবারই আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে। ধারণামতো অনেকেই এ নিয়ে অসূয়ক মন্তব্য করেছেন, স্বাধীন সামরিক বিশ্লেষক আলেক্সান্ডার গোল্টস বলেছেন, ‘কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে এটি দারুণ।’ আবার সাবেক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পি জে ক্রাউলি বলেছেন, পুতিন সিরিয়ায় নাক গলিয়ে ‘ইতিবাচক যা নেওয়ার নিয়ে নিয়েছেন।’ কিন্তু এ ব্যাপারে আরও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।
পুতিন আসলে বাশারকে বলছেন, বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পাঁচ বছর পর তাঁর জেনেভা আলোচনা নিয়ে আন্তরিকভাবে চিন্তা করা উচিত, আর শেষমেশ তাঁর আপসে আসা উচিত। সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাশারের ভবিষ্যৎ নিয়ে জেনেভায় আলোচনা করা যাবে না, এ কথায় রাশিয়া কুপিত হবে। সম্ভবত পুতিন এই পরিপ্রেক্ষিতেই হঠাৎ করে রুশ সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন।
যদিও রাশিয়ার যুদ্ধবিমানগুলো সিরিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিয়েছে, ক্রেমলিনের কঠোর বার্তা হচ্ছে, বাশার সামরিক বিজয়ের জন্য রুশদের ওপর নির্ভর করতে পারেন না। তাঁকে রাজনৈতিক সমাধানে আসতে হবে।
পশ্চিমা রাজনীতিকেরা প্রায়ই দাবি করেন, রাশিয়া সব সময় বাশারকে বাঁচাতে তৎপর, কিন্তু কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, এর বিপরীত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। রাশিয়া সিরিয়ায় আক্রমণ শুরু করার পর মস্কোয় গত শরতে বাশার ও পুতিনের মধ্যে যে বৈঠক হলো, তখন দেখা গেল, পুতিন গণবিবৃতি দেওয়ার সময় ক্যামেরার সামনে বারবার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য ‘সিরীয় জনগণের’ প্রশংসা করছেন। তিনি কখনোই ব্যক্তিগতভাবে বাশারের প্রশংসা করেননি।
পুতিন এ কথাও জোর দিয়ে বলেছেন যে তাঁর সামরিক হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য হচ্ছে, শান্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা। তিনি বাশারকে বলেছেন, আমরা আপনাকে পরাজয় ও অপসারণ রুখতে পারি, কিন্তু আপনি এটা আশা করতে পারেন না যে আমরা আপনাকে চিরকাল ক্ষমতায় রাখব।
এরপর রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী সিরিয়ার সমস্যা নিরসনে ভিয়েনায় বৈঠক করল, তখনো পরিষ্কারভাবে এ বার্তা দেওয়া হয়েছে। রাশিয়া সিরিয়ার সংকটকে ‘গৃহযুদ্ধ’ হিসেবে দেখে, যেটা বাশার ও তাঁর কর্মকর্তারা কখনো নকল করেননি। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছিলেন, এটা ‘রীতিসিদ্ধ সশস্ত্র বিরোধিতা’। বাশারের শব্দায়ন থেকে এর পার্থক্য বেশ বড়ই। সিরীয় প্রেসিডেন্ট এই সংগ্রামকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, তুরস্কসহ অন্যান্য দেশ যদি জিহাদিদের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে চায়, তাহলে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বড় কিছুর অংশীদারত্ব পাওয়ার লক্ষ্যেই পুতিন সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন। তিনি রাশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে ঢুকিয়েছেন রুশরা এর কোনোটিই করবে না। তারা বাস্তবতা দেখেছে, সেটা হলো এই দ্বন্দ্বটা মূলত গৃহযুদ্ধ, যদিও এর অনেকটাই বাইরের শক্তিগুলো ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। লাভরভ ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সদস্যদের আলোচনার জন্য মস্কোয় ডেকেছেন। ক্রেমলিন অন্যান্য বাশারবিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গেও কথা বলেছে, যেমন সিরীয় কুর্দি গোষ্ঠী, যারা ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে স্থলযুদ্ধে সবচেয়ে ভালো করেছে। তারা সবেমাত্র মস্কোয় কার্যালয় খুলেছে।
শুরু থেকেই পুতিন এটা পরিষ্কার করে আসছেন যে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের লক্ষ্য কিন্তু উন্মুক্ত নয়। তিনি যে যুদ্ধটা ছয় মাসেরও কম সময়ে নামিয়ে আনলেন, এই সিদ্ধান্তটা তিনি সম্ভবত সামরিক উপদেষ্টাদের সংযমী মূল্যায়নের ভিত্তিতেই নিয়েছেন। এই যুদ্ধে বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে অনেক হইচই হয়েছে। সিরিয়ার উন্নত মানের বিমান আছে, তারা ব্যারেল বোমা ফেলার ব্যাপারে অব্যাহতি পেয়েছে। বাইরের দুনিয়ার ধারণা হলো, এই যুদ্ধে যত মানুষ মারা গেছে, তার ৯০ ভাগই বেসামরিক। সিরিয়ার সুশীল সমাজ ও অ-ইসলামি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এ কথা ক্রমাগত বলে যাচ্ছে।
তারা এখনো এই অলীক কল্পনার জগতে বাস করছে যে যুদ্ধের মানবিক সংকটের ব্যাপারটা বারবার প্রচার করা হলে পশ্চিম সামরিক শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসবে, ২০১১ সালে তারা যেমন লিবিয়ার বেলায় করেছিল।
কথা হচ্ছে, লাখ লাখ সিরীয় বেসামরিক মানুষের দুর্গতির ব্যাপারটা খাটো করা যাবে না তা ঠিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়ার আছে: রেকর্ড থেকে দেখা যায়, সিরিয়ায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা মোট মৃত্যুর অর্ধেকেরও কম। এ বছরের প্রথম মাসের কথাই বিবেচনা করুন, যখন রুশ ও সিরীয় বিমান হামলা তুঙ্গে ছিল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরীয় অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস ২০১৬ অনুসারে জানুয়ারি মাসে সেখানে ৪ হাজার ৬৮০ জন মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ ছিল বেসামরিক মানুষ, সরকারি বাহিনী ও সরকারপন্থী রক্ষীবাহিনী ও ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সেসের ১ হাজার ৪৮৭ জন সেনা মারা গেছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৮০ জন অ-সিরীয় জিহাদি ও ৬০৩ জন বাশারবিরোধী যোদ্ধা মারা গেছে।
এই তথ্যের মধ্যে আলোর দিশা পাওয়া যায়। এই মন্ত্র সব সময় জপ করা হচ্ছে যে, ‘বাশার নিজের মানুষকে হত্যা করছেন’, তারা এ-ও বলছেন, বাশারবিরোধীরাও নিজের ভাইবোনদের হত্যা করছেন। এটা একটা ধ্রুপদি গৃহযুদ্ধ, যেখানে বন্দুকধারীরাই বেসামরিক মানুষের চেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছে। রুশরা সেটা দেখে শিক্ষা নিয়েছে। রুশদের বিমান হামলার সহায়তা নিয়ে বাশার বিদ্রোহী-অধ্যুষিত আলেপ্পোর একটি অংশ পুনর্দখল করতে পেরেছে। আর ডিসেম্বর ও জানুয়ারির একটা সময় মনে হয়েছিল, তারা পুরো শহরটাই দখল করে নিতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ হয়নি। সরকারি বাহিনী অনেক রক্তক্ষয় করেও সফল হতে পারেনি।
পুতিন বাশারকে বলেছেন, ‘আমরা আপনাকে নতুন জীবন দিয়েছি। আমরা লাতাকিয়া ও ইদলিবের আশপাশের এলাকা আপনার দখলে এনে দিয়েছি, আলেপ্পোর আশপাশে আপনাকে অনেক দূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছি। মার্কিন ও তাদের তাঁবেদারদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি করে দিয়েছি। এখন আপনার পালা, নিজ দেশের আইনসম্মত বিরোধী দলের সঙ্গে আপনাকে সমঝোতায় আসতে হবে।’
বড় কিছুর অংশীদারত্ব পাওয়ার লক্ষ্যেই পুতিন সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন। তিনি রাশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে ঢুকিয়েছেন। এখানকার কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আর শেষমেশ বলটা দামেস্কের কোর্টে ঠেলে দিয়েছেন।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া; অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জোনাথন স্টিল: দ্য গার্ডিয়ানের কলামিস্ট।

No comments

Powered by Blogger.