চতুর্দিকে সর্বনাশের ঘণ্টাধ্বনি! by ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

দেশ, রাষ্ট্র, জনগণ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি সব কিছু আজ ফ্যাসিবাদের যূপকাষ্ঠে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। একটি বিকাশমান অর্থনীতি ক্রমেই পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি আজ লুটেরাদের হাতে বন্দী। ঘুষ-দুর্নীতি প্রবেশ করেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সাধারণ মানুষ আজ অনিরাপদ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন এক আতঙ্কের নাম। বিপদে সাহায্যের জন্য পুলিশের কাছে ঘেঁষতেও ভয় পেতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। কাগজে কাগজে শিরোনাম হয়েছে- ‘ফুয়েল না দিলে ফাইল নড়ে না’। কোথাও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর মতো স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সর্বত্র এমন সব লোককে নিয়োগ বা দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, যারা কেবলই ‘জো-হুকুম’ টাইপের মোসাহেব। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় লাগামছাড়া হয়ে গেছে দুর্নীতি। ব্যাংকগুলো লুট হয়ে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত এই লুটেরাদের কাছে বড় বেশি অসহায়। তিনি বলছেন, দলীয় লোকদের চাপের কারণে লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’য় দেয়া হয়েছে ব্যাংকের লাইসেন্স। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো কথায় পাত্তা দিচ্ছে না। সেখানেও ইতোমধ্যে জাঁকিয়ে বসেছে দুর্নীতি আর অনিয়ম। বেসিক ব্যাংক লুটে খেলেন যে শেখ বাচ্চু, তার নাম পর্যন্ত যেন কেউ নিতে সাহস পাচ্ছিল না। কিন্তু কী শক্তি এই লুটেরার? কোন খুঁটির জোরে তিনি আছেন বহালতবিয়তে, তার কোনো হদিস মিলছে না। অবশেষে অর্থমন্ত্রী সংসদে বললেন, বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির সাথে জড়িত আছেন ওই শেখ বাচ্চু, আজ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কিন্তু কেন? সে প্রশ্নের জবার দেয়ার মতো কেউ নেই। এমনকি অর্থমন্ত্রীও না।
থানায় গেলে আরো মরণ। একটি জিডি করতেও ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা লাগে। থানার চেয়ার-টেবিলও ঘুষ খায়। এর মধ্যে আছে আবার পুলিশের সোর্স। তারা পুলিশকে চিনিয়ে দেয়, কাকে আটক করলে মুক্তিপণ আদায় করা যাবে। প্রতিদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে পুলিশের প্রধান পুলিশের অত্যাচার-নির্যাতনকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। ফলে বিচ্ছিন্ন ঘটনার পাহাড় জমে গেছে। পুলিশের এই অপরাধের আজব এক সাজার নাম হয়েছে ‘ক্লোজড করা’ বা ‘প্রত্যাহার করা’। এর মাধ্যমে পুলিশ যেন বাঙালকে হাইকোর্ট দেখায়। আমরা প্রতিদিন হাইকোর্ট দেখছি। এ ক্ষেত্রেও দলীয়করণ বা আঞ্চলিককরণের কুপ্রভাব আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। কনস্টেবল যদি গোপালগঞ্জের হয়, তাহলে সে ওসিকেও মানতে চায় না। পুলিশের চেইন অব কমান্ড রসাতলে গেছে। প্রতিদিন পুলিশ অপরাধ করছে। প্রতিদিন ক্লোজড বা প্রত্যাহার হচ্ছে। তাতে তাদের অপরাধ কমছে না। কারণ সে জানে, তাকে শায়েস্তা করার কেউ নেই। আর সে কারণেই পুলিশ অহঙ্কার করে বলতে পেরেছেÑ ‘মাছের রাজা ইলিশ আর দেশের রাজা পুলিশ।’ সরকার তার বিরোধীদের দমনে নির্বিচারে যথেচ্ছ পুলিশকে ব্যবহার করছে। ফলে তার নিজেকেই দেশের রাজা মনে হচ্ছে।
এ দিকে সংদদে আবার প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, জামায়াত-শিবিরসহ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদযুক্ত ব্যক্তিরা যেন কোনোভাবেই পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়োগ না পেতে পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, আগুনসন্ত্রাসীরা যেন শৃঙ্খলিত একটি বাহিনীতে ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে পুলিশকেই সজাগ থাকতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না, তবে আশা করি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। তিনি বলেন, পুলিশ নিয়োগে যাতে জঙ্গি সন্ত্রাসী ও জামায়াত-শিবির না ঢুকতে পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে তার হাজারবার বলা মানুষ পুড়িয়ে মারার কাহিনী পুনরুল্লেখ করে বলেন, এমনকি পুলিশ সদস্যরাও বিএনপি-জামায়াতের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তারা ১৮-১৯ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে। পুলিশবাহিনী যখন জনবল গ্রহণ করে, তখন এর দায়িত্বে থাকেন পুলিশবাহিনীর অফিসারেরা। তাই তাদের এ কথাগুলো মনে রাখা উচিত। এমপিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের নিজ নিজ এলাকায় এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল তারা কেউ যদি পুলিশ বাহিনীতে ঢুকে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই এসব তথ্য গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে দেবেন এবং তারা সেটা নিশ্চয়ই যাচাই-বাছাই করে দেখে ব্যবস্থা নেবে।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য একসাথে অনেক মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। প্রথমত, কেউ জামায়াত-শিবির বা বিএনপি করলে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরি দেয়া যাবে না, সংবিধান তার এ বক্তব্য সমর্থন করবে না। তাহলে এই বাহিনীতে যা কিছু চাকরির সৃষ্টি হবে, তার সবই দিতে হবে আওয়ামী বা সরকার দলের সমর্থকদের। এটা সংবিধানের স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। চাকরির ক্ষেত্রে এ দেশের সব নাগরিকের অধিকার সমান। শুধু রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কাউকে চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আসলে সব চাকরি দিতে হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে। কারণ, এ দেশকে কেউ আওয়ামী লীগের কাছে ইজারা দেয়নি। এখানে সব নাগরিকের অধিকার সমান। এ দিকে তার কথায় আবার ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া পুলিশবাহিনী নতুন করে বিরোধী দল দমনের একটি লাইসেন্স পেল। এখন তারা বিরোধী দলের সদস্যদের গ্রেফতারবাণিজ্যে আরো মহা উৎসাহে লেগে যেতে পারে। আবার এমপিদের উদ্দেশে তিনি যে বললেন, তারা যেন খোঁজ নেন, তার এলাকায় জামায়াত বা বিএনপির কেউ পুলিশবাহিনীতে ঢুকেছে কি না। ঢুকে থাকলে এমপিরা যেন তা গোয়েন্দা বাহিনীকে জানান, যাতে তারা ব্যবস্থা নিতে পারে।
পুলিশে চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে এমপিদের এমনিতেই কোনো সুনাম নেই। তার ওপর যদি তারা এই বাণিজ্য শুরু করেন, তবে পরিস্থিতি কী ভয়াবহ রূপ নিতে পারে তা সহজেই ধারণা করা যায়। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপিরা পুলিশকে এই ভয় দেখিয়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে যে বাধ্য করবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সবার চাকরির অধিকার হরণ করে নিলে সমাজের ভেতরে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হবে, পুলিশ বা আওয়ামী মাস্তান দিয়ে তার সমাধান করা কোনোমতেই সম্ভব হবে না। এতে সমাজে সহিংসতা বাড়তে বাধ্য। সে সহিংসতা হানাহানির পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেই। তাতে বর্তমান ফ্যাসিবাদী শাসকদের তখত মজবুত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ধারণা করি, সরকার এ ধরনের পরিস্থিতিতে গেলে দেশে এক চরম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
কোনো ফ্যাসিবাদী সরকার কখনোই স্বাধীন সংবাদপত্রকে সহ্য করে না। বর্তমান সরকারও তা করছে না। তারা ইতোমধ্যেই দৈনিক আমার দেশ, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যান্য টিভি চ্যানেলও সরকারের নিয়ন্ত্রণে ও মালিকানায়। ভিন্নমতের সংবাদপত্র যা এখনো প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলোও হুমকির মুখে। অনেক সংবাদপত্রে সরকারি চাপে করপোরেট হাউজ বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিতে পারছে না। এর মধ্যে সরকারি চাপের মধ্যে পড়েছে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো। এ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ওলটপালট করে দেয়ার ক্ষেত্রে এ দু’টি পত্রিকা নিন্দনীয় ভূমিকা পালন করেছে, সন্দেহ নেই। তারা গণতান্ত্রিক সরকারের বদলে মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের ১/১১’র অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় এনে গর্বের সাথে তা ঘোষণাও করেছে। ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম সম্প্রতি উপলব্ধি করেছেন, ওই অগণতান্ত্রিক সরকারের সময় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহকৃত খবর কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করে প্রকাশ করা ছিল তার সাংবাদিক জীবনের বড় ভুল। তাদের সে ভুলে জাতি এখন ফ্যাসিবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে এবং জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।
সরকারও মওকা পেয়ে এখন তাদের বিরুদ্ধে এক হাত নিয়েছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগাররা মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে প্রায় ৮০টি মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করেছে। সরকার যখন আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক ৭০টি মামলা দায়ের করল, তখন তারা দায়সারা গোছের কিছু কথা বলেছিলেন বটে। তখন মাহফুজ আনামরা বোধকরি কল্পনাও করেননি, এক সময় তাদেরও একই ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। তবে এ বিষয়ে আমরা দায়সারা গোছের কোনো কথা বলতে চাই না। আমরা বলতে চাই, মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সরকারের যে বিষোদগার, তার প্রতিবাদ আমরা করি। অন্তত সত্যোপলব্ধি তো তার হয়েছে। তাকে বিচারের মুখোমুখি করার ঘোষণায় আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ, তাদের তৎপরতার ফলে মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন সাময়িকভাবে ক্ষমতায় এলেও চূড়ান্ত বিচারে লাভবান হয়েছে আওয়ামী লীগ। তারা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিলের ভাষায় মইন-ফখরের সাথে ‘আঁতাতের নির্বাচন’ করে এখন ক্ষমতায় আসীন আছেন। আর মাহফুজ আনামরা যেমন গর্ব করে বলেছিলেন, তারাই ওই রাষ্ট্রঘাতী সরকারকে ক্ষমতায় এনেছেন, একইভাবে শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, ওই সরকার ছিল তাদের আন্দোলনের ফসল। আর ওই সরকার যা কিছু ব্যবস্থা বিএনপির বিরুদ্ধে নিক, তিনি তার বৈধতা দেবেন। দিয়েছেনও। তাহলে মাহফুজ আনাম একা কেন দোষী হবেন? এর দায়ভার তো শেখ হাসিনাকেও নিতে হয়। এ ছাড়া শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার কাতারে যারা ছিলেন, তাদের প্রায় সবাই এখন শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা অলঙ্কৃত করছেন। বিচার হলে তো তাদেরও হওয়া উচিত।
এই দ্বিচারিতা আওয়ামী লীগকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তাদের পায়ের নিচের ঝুরঝুরে মাটির নিচে দাবিয়ে দিতে খুব বেশি সময় নেবে বলে মনে হয় না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.