ফোর ইন ওয়ান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ by শাহদীন মালিক

ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকের ঘটনা। খোঁজাখুঁজি করলে প্রথম আলোসহ অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সঠিক দিন, হেডলাইনের ভাষা ইত্যাদি পাওয়া যাবে। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বৃত্তান্ত এখানে ততটা গুরুত্বপূর্ণ না, মূল কথাটাই মুখ্য।
কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহ নামের এক শিশু অপহৃত হয়েছিল। অপহরণকারীরা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। লাখ দুয়েক টাকা (যত দূর মনে পড়ে) মুক্তিপণ দেওয়াও হয়েছিল। কিন্তু আবদুল্লাহ ফিরে আসেনি। দিন পাঁচেক পর তার গলিতপ্রায় লাশ পাওয়া গিয়েছিল। মুক্তিপণ আদায় ও ঘটনাবলির অন্যান্য পরম্পরার সূত্র ধরে দুই আসামি গ্রেপ্তার হলো। মূল আসামি হিসেবে শনাক্ত হলো জনৈক মোতাহার। র্যা ব গ্রেপ্তার করল মোতাহারকে। ‘ক্রসফায়ারে দিল’। মোতাহার নিহত হলো।
বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে নিহত আবদুল্লাহর বাবা-মায়ের বক্তব্য শুনলাম। তাঁরা সন্তুষ্ট। তাঁদের ছেলের হত্যার সঠিক বিচার হয়েছে। খুনির শাস্তি (ক্রসফায়ারে নিহত হওয়া) হয়েছে। টেলিভিশন আরও দেখাল—এলাকাবাসীও ভীষণ সন্তুষ্ট। এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে।
র্যা ব তার সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। দু-চারজনের মনে না-ও থাকতে পারে, তাই পুরোনো খবরের পুনরাবৃত্তি করছি। ২০০৪ সালের দিকে, যত দূর মনে পড়ে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। আজকাল কালেভদ্রে পত্রপত্রিকায় তাঁর ছবি দেখা যায় (হাতকড়া পরানো, প্রিজন ভ্যান থেকে হয় নামছেন বা উঠছেন) আর সম্ভবত তারেক রহমানের ছবি দেখা বা কথা শোনা যায় না, কারণ হাইকোর্ট পলাতক আসামির খবর প্রকাশ/প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। অনেকটা তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় সৃষ্ট র্যা ব তখন যা করত, আজও প্রায় তা-ই করছে। ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ চলছেই। ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে মোতাহারের পর শিশু হত্যাসংক্রান্ত ২৬ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার খবরের শিরোনাম: ‘বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন নিহত...’। অবশ্য শিরোনামে আরও ছিল ‘...বিচার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা’।
হবিগঞ্জের বাহুবলের চার শিশু হত্যার মূল সন্দেহভাজন আসামি বাচ্চু বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ২৫ তারিখে, অর্থাৎ আগের দিন। সেই খবর। বিচার তো হয়েই গেল, আবার শঙ্কা-টঙ্কা কী?

দশক চারেক আগে, কিছু কমও হতে পারে, ‘টু ইন ওয়ান’ প্রথম বাজারে এসেছিল। টেপ বা ক্যাসেট প্লেয়ার, আর সঙ্গে রেডিও। তাই টু ইন ওয়ান। তারপর থ্রি ইন ওয়ান। অর্থাৎ ক্যাসেট আর সিডি প্লেয়ার, আর সেই সঙ্গে রেডিও। এখন যুগ ‘ফোর ইন ওয়ান’-এর।

বিচার-আচার দেশ থেকে উঠে গেছে—এটা তো বলা যাবে না। তবে ‘রূপ’ নিশ্চয়ই পাল্টেছে। আমরা সবাই একেবারে গোড়ার কথায় গিয়ে ঠেকেছি। এবং সেটা খোদ প্রধান বিচারপতির কথার জের ধরে। বিচারপতিরা রায় কখন লিখবেন, মামলার শুনানির পর? নিয়ম মেনে সময়মতো রায় যে লেখা হয় না, তা তো না। রায় লেখা হতো, হচ্ছে। প্রশ্নটা এখন সময় নিয়ে। তবে অন্য কিছু প্রশ্নও উঠে এসেছে কারণ, খোদ প্রধান বিচারপতিই তো কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ কে খান আইন অনুষদ ভবন’ উদ্বোধন করার বক্তৃতায় বলেছিলেন যে টেলিফোনে নির্দেশনা পেয়ে রায় আর লেখা হয় না।
শুনানি শেষের পরে যদি রায় লেখা হয় তবে, প্রশ্ন হলো কত পরে? এক বছর, দুই বছর, তিন বছর? অবসর হয়ে যাওয়ার পর কত বছর তক? রায় লেখা অবশ্য অতি দুরূহ ব্যাপার। বিশেষ করে উচ্চ আদালতের। এখানে সিদ্ধান্ত বা ‘ডিসিশন’-এর সঙ্গে আইনের ব্যাখ্যার প্রশ্নও জড়িত।
আগে হাইকোর্টের নিয়ম ছিল পুরো রায়টা—অর্থাৎ এ ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদীর আইনজীবী তাঁর পক্ষে এই এই তথ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। পক্ষান্তরে বিবাদীপক্ষের আইনজীবী বাদীর বক্তব্য এই এইভাবে খণ্ডন করেন। নিজের পক্ষে এই সেই তথ্য, যুক্তি প্রদান করেছেন। রায়ে এসব কথা বলে রায় প্রদানকারী বিচারপতি উভয় পক্ষের তথ্য ও আইনি যুক্তির মূল্যায়ন করে আস্তে আস্তে কোন পক্ষের আইনগত অবস্থা সঠিক, সেদিকে এগিয়ে যেতেন। দুই-তিন-চার ঘণ্টা ধরে বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মৌখিক বক্তব্যের পর একেবারে শেষে গিয়ে বলেন, মামলাভেদে—রুল ইজ মেড অ্যাবসলিউট। অর্থাৎ বাদী জিতেছে। অথবা বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হলে ‘রুল ইজ ডিসচার্জড’।
মাননীয় বিচারপতির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুনে আমরা বুঝতে পারতাম, রায়টা কেন আমার মক্কেলের পক্ষে/বিপক্ষে গেল। মাননীয় বিচারপতির ডিকটেশনটা বেঞ্চ অফিসার শর্টহ্যান্ডে লিপিবদ্ধ করেন। পরে টাইপ করে বিচারপতিদের দেন। তাঁরা পড়ে, কারেকশন করে চূড়ান্ত করেন এবং অবশেষে তিন/চার মাস পর আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পাই। গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলো বিভিন্ন ল রিপোর্টে ছাপা হয়।
তবে আজকাল কোনো কোনো বিচারপতি কিছু কিছু মামলায় এক লাইনে শেষের কথা—অর্থাৎ ‘আপিল অ্যালাউড’ (আপিলকারী জিতেছে) বা ‘রুল ডিসচার্জড’ বলে শেষ করে দেন। ফলে পুরো রায়টা দু-তিন বছরেও পাওয়া যায় না। বিচারপ্রার্থীর ভোগান্তির অন্ত থাকে না।
‘স্যার, রায় কখন পাব’ প্রশ্নের জ্বালায় মক্কেলের ফোন ধরি না।
তাই হয়তো প্রধান বিচারপতি রায় কত দিনে লিখবেন, প্রশ্নটা সামনে নিয়ে এসেছেন। তবে কোনো সুরাহা আজতক হয়েছে বলে শুনিনি। আমরা সমস্যা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করতে পারদর্শী। কিন্তু সমাধান খুঁজে পাই না।
কোনো কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করার জন্য যে আয়োজন-সরঞ্জাম-কর্মকর্তা ইত্যাদি প্রয়োজন, তার প্রায় কিছুই আমাদের আদালত ব্যবস্থায় নেই। এসবের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না। ফলে অবস্থার পরিবর্তনের আশা খুবই অল্প। কিন্তু আদালতে যন্ত্রপাতি (কম্পিউটার ইত্যাদি) সাজ-সরঞ্জাম, দক্ষ কর্মকর্তাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংস্কার অত্যাবশ্যক। সংস্কার যত দেরিতে হবে, বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি তত বাড়বে আর বিচারব্যবস্থার ওপর কমবে আস্থা।

সমস্যা আরও আছে, আজকাল আইন-মামলা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের ধারণাগুলো হয়ে উঠছে অত্যন্ত গোলমেলে।
পুরোনো এবং অনেকেরই জানা চুটকি। মক্কেল গেছে ভালো উকিলের কাছে। উকিল সাহেব মক্কেলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, কাগজপত্র দেখে বলে দিলেন যে তার মামলা চলবে না।
মক্কেল উত্তেজিত—আপনি না বড় উকিল, মামলা চালাতে পারবেন না, এটা কী কথা? ব্যর্থ মনোরথ হয়ে মক্কেল চলে গেল, পরদিন অন্য উকিল তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে মামলা দায়ের করে দিল। মামলা চলল বছর পাঁচেক। মক্কেলের কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ গেল উকিলের পেছনে, উকিলের সেরেস্তায়। শেষ পর্যন্ত মামলা খারিজ। এ জন্যই প্রথম উকিল মামলা ফেরত দিয়েছিল। কিন্তু মামলা ঠিকই চলেছিল পাঁচ বছর।
মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা চলা শুরু হয়েছে। মামলা সংখ্যা ৭৮–এ পৌঁছেছে বলে জেনেছি। অনেককে বলতে শুনেছি, এগুলো তো দেওয়ানি মামলা। ক্ষতিপূরণ চেয়েছে সে, যে মামলা করেছে। হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ।
জানলাম প্রথম যে ফৌজদারি কোর্টে আজকাল দেওয়ানি মামলা চলছে ডজন ডজন, সারা দেশের বিভিন্ন আদালতে। দেওয়ানি মামলায় অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট হচ্ছে। আর এতকাল জানতাম, আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি মামলা করতে হলে ‘কোর্ট’ ফি দিতে হয়। কোটি টাকা বা তার বেশি ক্ষতিপূরণ চাইতে হলে আদালতে ‘ফি’ দিতে হয় হাজার পঞ্চাশেক টাকা।
পুলকিত হয়ে দেখছি ‘কোর্ট’ ফি ছাড়াই মামলা চলছে।
যে ‘ডিফেমড’ অর্থাৎ যার মানহানি হয়েছে, মানহানির মামলা করবে সে স্বয়ং, আইনে এর তিনটি ব্যতিক্রম দেওয়া আছে। যার মানহানি করা হয়েছে সেই ব্যক্তি যদি মৃত হয়, অথবা উন্মাদ হয় অথবা ‘পর্দানশিন’ মহিলা হয়, তা হলে তার পক্ষে অন্য ব্যক্তি মানহানির ফৌজদারি মামলা করতে পারবে। অন্যথায় মামলা চলবে না। অথচ মামলা চলছে। সেই দ্বিতীয় উকিলের মতো—মামলা চলবে না মানে! চালালেই চলবে।
আরেক নীতিনির্ধারক বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনীতে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে বিধান করা হয়েছে। সেহেতু এক-এগারোর ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী অবৈধ/অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখলের মামলা করা হবে। ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭-এ। পঞ্চদশ সংশোধনী হয়েছিল ২০১১-তে। ঘটনার পর আইন পরিবর্তন করে নতুন আইনের অধীনে পুরোনো ঘটনার বিচার করা যায় না। এ ব্যাপারে ২০০৯-এর বিডিআর বিদ্রোহের পর খোদ রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই আপিল বিভাগ উত্তর দিয়েছিলেন, না, ঘটনার পর আইন পরিবর্তন করে আগের ঘটনার বিচার করা যাবে না। সংবিধানের ৩৫ (১) অনুচ্ছেদেও এ কথাই বলা আছে।
তাতে কী। এ দেশে এখন মামলা চালাতে চাইলেই চলে।

এখন ফোর ইন ওয়ানের যুগ। অভিযোগ গ্রহণ করে র্যা ব। তদন্ত করে র্যা ব। দোষ-নির্দোষ সিদ্ধান্ত নেয় র্যা ব। শাস্তি কার্যকর করে র্যা ব। ফোর ইন ওয়ান। যেসব ব্যাপার বা ঘটনায় র্যা বের কোনো ইন্টারেস্ট নেই, সেসব ঘটনায় আমরা আদালতে মামলা চালাই।
এই অধম নিশ্চিত, ২০৪১ সাল পর্যন্ত এ দেশের জনগণকে অপেক্ষা করতে হবে না। তার অনেক আগেই আমরা উন্নত বিশ্বের কাতারে যোগ দেব। তবে আইনের শাসন বাদ দিয়ে। চলবে র্যা বের শাসন, পুলিশের শাসন, রিমান্ডের শাসন এবং আরও নতুন নতুন শাসন। জাদুঘরে ঢুকবে আইনের শাসন।
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.