দুর্বৃত্তদের টার্গেট শিশুরা by আবু সালেহ আকন

অল্পতেই টার্গেট হচ্ছে শিশুরা। সন্ত্রাসী-অপরাধী তো রয়েছেই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সুযোগ পেলে শিশুদের নির্যাতন করতে ছাড়ছেন না। গৃহের বাইরে সর্বত্রই শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে অপহরণের যেসব ঘটনা ঘটছে তার বেশির ভাগ হচ্ছে শিশু। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিশুদের টার্গেট করা সহজ, ঝুঁকি কম। তারা প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। তাই শিশুরা বেশির ভাগ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, মানবাধিকার কর্মী এবং বিশেষজ্ঞ সবার একই মত যে শিশুদের ওপর নির্যাতন করা সহজ। সে কারণেই শিশুদেরকে দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসী, পরিচিতজন সবাই টার্গেট করে থাকে। পরিবারে পরিবারে দ্বন্দ্বেও দেখা যায় টার্গেট হচ্ছে শিশুরা। দুর্বৃত্তদের টাকা দরকার সেখানেও টার্গেট শিশু। কোনো কিছু আদায় করতে হবেÑ পণবন্দী করা হয় শিশুদেরকে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এই অবুঝ শিশুদের ওপর নির্যাতন করে থাকে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা গ্রামে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগ এনে দুই শিশুকে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় এক শিশুর বাবা ইমরান আলী বাদি হয়ে পবা থানায় গত শনিবার একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় বগুড়া সেনানিবাসে কর্মরত সেনাসদস্য নাসির উদ্দিন, র‌্যাব সদস্য ও পুলিশ কনস্টেবল সাগরসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়। দুই শিশুকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। গত বছর সিলেটে রাজন নামের এক শিশুকে একই কায়দায় মোবাইল চুরির অভিযোগ এনে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
গত ১৫ জানুয়ারি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ পৌর এলাকার কংগাইশ গ্রামের পাল পুকুরিয়ায় খড়ের গাদায় ৫ ঘণ্টা বেঁধে রাখা হয় তিনটি শিশুকে। চুরির অভিযোগে স্থানীয় ব্যবসায়ী মিজান তিন শিশুকে তার বাড়িতে বেঁধে রাখেন। যাদের মধ্যে একটি মেয়েশিশুও রয়েছে।
ঢাকার কেরানীগঞ্জে গত ২৯ জানুয়ারি আবদুল্লাহ নামের একটি শিশুকে অপহরণ করা হয়। তার মুক্তিপণ হিসেবে দুর্বৃত্তরা ৫ লাখ টাকা দাবি করে। বিকাশের মাধ্যমে দুই লাখ টাকাও দুর্বৃত্তদের কাছে পাঠায় শিশুটির পরিবার। এরপরও শিশুটিকে মেরে ফেলে দুর্বৃত্তরা। গত ২ ফেব্রুয়ারি এক প্রতিবেশীর বাড়ির ছাদ থেকে উদ্ধার করা হয় শিশুটির লাশ। আবদুল্লাহ অপহরণের এক দিন আগে-পরে রূপগঞ্জ, পাবনা ও মানিকগঞ্জে আরো চার শিশুকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করা হয়।
গত ১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের এক বাসা থেকে সদ্যজাত সন্তানকে নিচে ফেলে দেন কিশোরী মা বিউটি। প্রসবের পরপরই শিশুটিকে ৫ তলা থেকে মা ছুড়ে ফেলে দেন। এর এক দিন পরে গত ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরের মনিপুর থেকে নবজাতকের খণ্ডিত মস্তক উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার শিশুটির মা সোনিয়াকে আটক করে পুলিশ।
রংপুরের নিউ আদর্শপাড়ার মোছাদ্দেক হোসেন রাঙার শিশুসন্তান রহিমুল ইসলাম রওনক (৪) গত ১ ডিসেম্বর নিখোঁজ হয়। দুই মাস পর গত ৩০ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে রওনকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
নোয়াখালীর চরজব্বারের সুবর্ণচর এলাকার আনোয়ার হোসেনের মেয়ে মুন্নি আক্তার (১৩) প্রায় চার বছর রাজধানীর বনশ্রী এলাকার এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করত। গত ২৪ জানুয়ারি পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে।
ঢাকার ধামরাইয়ের চৌহাট এলাকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে শাকিল (১১) এবং আবু বকরের ছেলে ইমরান হোসেনকে (১১) অপহরণ করা হয়। পরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে শিশু দু’টির গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে দবির হোসেন (১৩) নামের এক পত্রিকা হকারকে গাছের সাথে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। পত্রিকা বিক্রির টাকা চাইতে গেলে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়।
চলতি বছরের প্রথম সাত দিনে চট্টগ্রামে ১১ বছরের আজিমকে গলা কেটে হত্যা, খুলনায় প্রতিবন্ধী মেয়েকে হত্যার পর বাবার আত্মহত্যা। এ ছাড়া গাজীপুরের ১২ বছরের শিশুশ্রমিক মোজাম্মেলকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ করেছে তার পরিবার।
সর্বশেষ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গাইবান্ধা ও গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে অপহৃত শিশু মোবারককে (৬) উদ্ধার করে। এ সময় অপহরণকারী মো: আবদুল জব্বার ওরফে ঠাণ্ডু ওরফে বাবলু ও তার স্ত্রী নাজমা আক্তারকে গ্রেফতার করা হয়। মোবারককে গত ২৯ ডিসেম্বর উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ৬ নম্বর রোডে বাসার সামনে থেকে অপহরণ করা হয়।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এলিনা খান নয়া দিগন্তকে বলেন, শিশুদের ওপর যখন নির্যাতন হয় তখন তারা প্রতিবাদ করতে পারে না, কাউকে বলতে পারে না। এ কারণেই শিশু নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনা ঘটে থাকে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবুল বাসার বলেন, শিশুরা দুর্বৃত্তদের সহজ টার্গেট। তাদেরকে সহজে অপহরণ করা যায়, গুম করা যায়, খুন করা যায় বলেই তাদের ওপর নির্যাতনও বেশি।
র‌্যাবের মিডিয়া উইং প্রধান মুফতি মাহমুদ খান বলেন, শিশুদের ওপর নির্যাতন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিচিতরাই করে থাকে। টাকার জন্য কাউকে অপহরণ করা হবে সে ক্ষেত্রে শিশুদেরকেই টার্গেট করা হয়। দেখা যায় সেখানে গাড়ির ড্রাইভারও জড়িত। আপনজন যখন একটি শিশুকে ডাক দেয় তখন শিশুটি তার সাথে চলে যায়। শিশুরা বোঝে না কোথায় তার বিপদ হতে পারে। তিনি বলেন, দেখা যায় পরিচিত লোকেরা যখন অপহরণ করে তখন চিনে ফেলায় শিশুটিকে মেরে ফেলা হয়।

No comments

Powered by Blogger.