মূল্যবোধের এত বিপর্যয় কেন?

নিহত তাজেল মিয়া
হবিগঞ্জের বাহুবলে চার শিশু হত্যার ঘটনাকে মূল্যবোধের বিপর্যয় হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনেরা। এ ধরনের নিষ্ঠুরতা বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অপরাধীদের বিকৃত মনোভাব এবং সমাজে শিশুদের অসহায় অবস্থার চিত্রই তুলে ধরছে।
একসঙ্গে চার শিশু হত্যার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কী বলব? মূল্যবোধের এত বিপর্যয় কেন ঘটছে? শিশুদের সঙ্গে কারও কোনো দ্বন্দ্ব, সংঘাত থাকে না। তাদের শুধু ভালোবাসা পাওয়ার কথা। অথচ তারাই নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। আর এ ধরনের ঘটনা আমাদের প্রতিনিয়ত সহ্য করতে হচ্ছে, যা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’ তাঁর মতে, এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটার পেছনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে।
শিশুহত্যা ও নির্যাতন এবং তাদের অধিকারের বিষয়গুলোর তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (২৬৭টি বেসরকারি সংস্থার জোট)। ১০টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে করা ফোরামের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে ২৯টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে কেরানীগঞ্জের স্কুলছাত্র আবদুল্লাহকে অপহরণ করে হত্যা করে লাশ ঘরের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয়। গাজীপুরে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে সোলায়মান নামে এক শিশুকে। কিশোরগঞ্জের নিকলীতে শিশুহত্যার অভিযোগে মাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাবনার ঈশ্বরদীতে দুই শিশুকে বিষ খাইয়ে মা আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে একটি শিশু মারা গেছে।
আর গত চার বছরে দেশে ১ হাজার ৮৫টি শিশুকে হত্যা করা হয়। পারিবারিক কলহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, ব্যক্তিগত লোভ অথবা স্বার্থ আদায়ের অস্ত্র হিসেবেই শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
হত্যার পাশাপাশি শিশু নির্যাতনও বেড়েছে। চলতি মাসেই রাজশাহীর পবা উপজেলার চৌবাড়িয়া গ্রামে মুঠোফোন চুরির অপবাদ দিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে জাহিদ হাসান (১৫) ও ইমন আলী (১৩) নামের দুই কিশোরকে অমানবিক নির্যাতন করে সেই ঘটনার ভিডিওচিত্রও ধারণ করা হয়। নাটোরের বাগাতিপাড়ার মাকুপাড়া গ্রামে দোকানে চুরির অভিযোগে তিন শিশুকে পেছনে দড়ি দিয়ে হাত বেঁধে বাঁশের লাঠি দিয়ে বেদম পেটানো হয়।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা ঘটে চলেছে তা খুবই দুঃখজনক। শিশুহত্যার ঘটনা এত বেশি পরিমাণে কেন ঘটছে, এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, তাও ভাবিয়ে তুলছে। তবে ঘটনা ঘটার পরই সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
নিহত জাকারিয়া আহমেদ
প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেখেশুনে মনে হচ্ছে অপরাধীদের মধ্যে একধরনের বিকৃত মনোভাব তৈরি হয়েছে। অপরাধীরা জানে শিশুদের আক্রমণ করা সহজ। শিশুরা পাল্টা আঘাত করতে পারবে না। তবে যে কারণেই শিশুরা হত্যার শিকার হোক, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
গত বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল সিলেটের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন ও খুলনার মোহাম্মদ রাকিব হত্যা। দেশের সচেতন মানুষ এ ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামে। নিম্ন আদালতে দ্রুত এ মামলা দুটির নিষ্পত্তি হয়। রাজন হত্যার দায়ে প্রধান আসামি কামরুলসহ চারজনকে ফাঁসি ও সাতজনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং রাকিব হত্যা মামলায় দুজনকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। তবে কেরানীগঞ্জে আবদুল্লাহ হত্যার ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ঘটনা সমাজে শিশুদের অসহায় অবস্থার সার্বিক চিত্রটাই তুলে ধরছে। সুশাসনের অভাব ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াও এমন অপরাধ সংঘটনের একটি বড় কারণ। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শিশুহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বাড়লেও দেশের রাজনীতিবিদেরা এ নিয়ে তেমন কথা বলেন না। সরকার দ্রুত এসব ঘটনার প্রকৃতি ও পুনরাবৃত্তিকে বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যমান সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো পর্যালোচনা করবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.