এবার যুদ্ধাপরাধী পাক সেনাদের বিচার

জড়িতদের পরিচয় ও তালিকা চেয়ে আইজি প্রিজন ও ডিসিদের চিঠি দিয়েছে আইসিটি * চাওয়া হয়েছে রাজাকারদের তালিকাও
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) এবার মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধে জড়িত চিহ্নিত পাকিস্তানি সেনাদের বিচার করবে। এজন্য প্রাথমিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জড়িতদের নাম, পরিচয়সহ বিস্তারিত তথ্য চেয়ে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) এবং জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার পর মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত পাক সেনাদের নামের তালিকা তৈরি করা হবে। সেখানে আগে চিহ্নিত ১৯৫ জন ছাড়াও আরও নাম অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। একই সঙ্গে তৈরি করা হবে পাক হানাদারদের সহযোগী রাজাকারদের হালনাগাদ তালিকাও। কিছুটা বিলম্বে হলেও এদের বিরুদ্ধে কার্যকর অনুসন্ধানে নেমেছে আইসিটি। আর তাই ট্রাইব্যুনালের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইসিটির তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক মুহা. আবদুল হান্নান খান পিপিএম যুগান্তরকে বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। আত্মসমর্পণ করা ১৯৫ জন পাক সেনাসদস্যসহ এসব অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতেই মূলত এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাদের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে কারা অধিদফতরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া পাক সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে ডিসিদেরও চিঠি দেয়া হয়েছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করতে ইতিমধ্যে আইসিটির তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত ৫ সদস্যের কমিটিও কাজ শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির যুগান্তরকে বলেন, ২৪ বছর ধরে আমরা এই দাবি করে আসছি। দেরিতে হলেও রাষ্ট্রীয় একটি সংস্থা যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ পাক হানাদার ও রাজাকারদের তালিকা তৈরির জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। এটিকে আমরা স্বাগত জানাই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা অধিদফতরসহ সরকারি দফতরগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকার কথা। নিজের সম্পাদনায় ‘একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি’ নামক মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতদের জবানবন্দির সংকলন বাজারে রয়েছে উল্লেখ করে সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ১৯৫ পাক সেনার বাইরেও কিন্তু অনেকের নাম রয়েছে। তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। প্রয়োজনে গণহত্যার ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ চাইতে হবে পাকিস্তানিদের কাছে।
সূত্র জানায়, আইসিটি থেকে ২৫ জানুয়ারি কারা মহাপরিদর্শককে লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের সব এলাকায় যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরিতকরণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে। এ সময় পাক সেনাবাহিনীর কমান্ডার বা অফিসার ও সদস্যদের অনেককেই গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়। সে মোতাবেক তাদের ওই সময় যেসব কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল সেখানে তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এমন বিবেচনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব পাক সেনার নাম-পরিচয় ও জেলখানার নাম, মামলা নম্বর ও অন্য তথ্যাদি চেয়েছে আইসিটি। জাতীয় গুরুত্ব বিবেচনায় জরুরিভিত্তিতে উল্লেখিত তথ্য সরবরাহ করার জন্য কারা মহাপরিদর্শককে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
একই দিনে এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে জেলা প্রশাসকদের কাছেও চিঠি দিয়েছে আইসিটি। চিঠিতে ১৯৭১ সালে স্ব স্ব জেলার আওতাভুক্ত এলাকায় তৎকালীন সময়ে অবস্থিত পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের নাম, স্থায়িত্বকাল, কমান্ডারের নাম, পদবি, সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মরত আনুমানিক সদস্য সংখ্যাসহ প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য দিতে বলা হয়। কমান্ডার ছাড়াও অন্যান্য সিনিয়র অফিসার, জেলাওয়ারি আনসার ও রাজাকার ক্যাম্পের নাম, আনসার ও রাজাকার ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত এডজুটেন্ড/কমান্ডারদের নাম, ঠিকানা ও বর্তমান অবস্থান, জীবিত না মৃত, সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পের রাজাকারদের নামের তালিকা, পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের নির্যাতন কেন্দ্রের নাম, স্থায়িত্বকাল, নির্যাতিত লোকের সংখ্যাও চাওয়া হয় এই চিঠিতে। এছাড়া জেলা কারাগারে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আটক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের নাম, ঠিকানা, কর্মস্থল ও অবস্থানের সময়ও উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
এর আগে ১৮ জানুয়ারি ১৯৫ পাকিস্তানি সেনাসদস্যের যুদ্ধাপরাধ তদন্তে আইসিটির তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। মতিউর রহমান যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ‘ইতিমধ্যে কমিটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে নৌ ও বিমান বাহিনীর আরও পাঁচজনসহ মোট ২০০ যুদ্ধাপরাধীর বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব পাকিস্তানি কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কে কোথায় অবস্থান করছিলেন, কী কী দায়িত্ব পালন করেছেন এবং কিভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, সেসব বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর ত্রিদেশীয় সিমলা চুক্তির আওতায় বিচার করা হবে বলে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ সেনা কর্মকর্তাকে পাকিস্তান ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.