সাদ্দামের সুন্নি ভাইরাই ভরসা হয়ে উঠেছে আইএসের! by ত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য

৫,০০,০০০। ৪,৮১১। সংখ্যা মাত্র। কিন্তু কিসের সংখ্যা? প্রথমটি, গত ১২ বছরে সংঘর্ষে মৃত ইরাকির সংখ্যা। দ্বিতীয়টি, একই সময়ে ইরাকের মাটিতে নিহত মার্কিন জোটের সেনার সংখ্যা। সংখ্যাগুলি শুনলে তিকরিতের কবরে সাদ্দাম হুসেন হয়তো পাশ ফিরে শুতেন! তবে এটুকু বোঝা যায়, তাকে হটিয়ে ১২ বছর ধরে চলা গণতন্ত্রের এই হাল দেখলে বিস্মিত হতেন না। হয়তো বলতেন, ‘‘এমন তো হওয়ারই ছিল।’’ শক্তির দম্ভে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার এই অবিমৃশ্যকারী মার্কিন প্রয়াস যে অচিরেই এই করুণ পরিণতি-র পথে যাবে, তা আন্দাজ করা সাদ্দামের পক্ষে অসম্ভব নয়। সাদ্দাম স্বৈরতান্ত্রিক। যেকোনো একনায়কের মতো ক্ষমতায় টিকে থাকার অনন্ত বাসনায় আক্রান্ত। সেই বাসনার দহনে ইরাক আক্রান্ত হয়েছে। গণহত্যা চলেছে। চলেছে অবদমন, নির্বাসন। সংখ্যালঘু সুন্নিদের দাপটের সামনে কার্যত অসহায় আত্মসমর্পণ সংখ্যাগুরু শিয়াদের। সামান্য প্রতিবাদ, মাথা তোলার খানিক চেষ্টাকে নিষ্ঠুর ভাবে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। কুর্দদের অবস্থা আরও সঙ্গীন। সন্দেহের বশে বিষাক্ত ‘সারিন’ গ্যাসও তাদের উপরে ব্যবহার করেছেন সাদ্দাম। কিন্তু তার পরে? উপরের দু’টি সংখ্যা ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে খানিকটা আন্দাজ দেয়। এই ইরাকের যত গভীরে যাওয়া যায়, তত ভয়াবহ ছবিটি পরিষ্কার হয়। ইরাকের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের কম। এই নবীনরা গত ১২ বছর ধরে শুধু রক্তপাত দেখে আসছে। দেখে আসছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চরম খেয়োখেয়ি। পরিকাঠামো নেই, শিল্প নেই, কর্মসংস্থান দূর অস্ত্। বিশ্বব্যাঙ্কের বেশ ক’টি পরিসংখ্যানে একবারে তলানিতে ইরাক। মার্কিন সেনাদের হাতে ধরা পড়ার পর সাদ্দাম হোসেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ জানাচ্ছে, দুর্নীতির তালিকায় ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১৭০তম স্থানে রয়েছে ইরাক। নাগরিক পরিষেবা ঠিক মতো মেলে না। গত গ্রীষ্মে ইরাকে তাপমাত্রা রেকর্ড ছুঁয়েছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ হয়েছে চাহিদার নামমাত্র (ইরাকের দরকার প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, উৎপাদন হয় সাকুল্য চার হাজার মেগাওয়াট)। এ বার অবস্থা সহ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় পথে নেমেছিল ইরাকের জনতা। দুর্নীতির অভিযোগে সরতে হয়েছিল বিদ্যুৎমন্ত্রীকে। ২০০৬-এ আজকের দিনে ফাঁসিকাঠে তোলা হয় সাদ্দামকে। ফাঁসির কয়েক দিন আগে বাথ পার্টি-র ওয়েবসাইটে একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই চিঠিতে আমেরিকা নয়, দেশীয় নেতৃত্বের থেকে জনগণকে সতর্ক করেছিলেন সাদ্দাম। চিঠির লেখক আদৌ সাদ্দাম কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু সতর্কতা যে অমূলক ছিল না, ইরাকের নেতৃত্ব তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। বাকি সব দূরে থাক, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ব্যবস্থাও করে উঠতে পারেনি। ক্ষমতা পেয়ে সংখ্যাগুরু শিয়াদের কর্তৃত্ববাদ সুন্নিদের শুধু বঞ্চিতই করেনি, ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ঠেলে দিয়েছে জঙ্গি মৌলবাদের দিকে। যার নিটফল ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থান। যা শুধু ইরাক বা সিরিয়াকেই নয়, বিপন্ন করেছে বিশ্বকে। কিন্তু শুধু শিয়া কর্তৃত্ববাদই কি আইএস-এর উত্থানের কারণ। এর পিছনে কি সাদ্দামের কোনো হাত আছে? আজ আইএস-এর এই দাপট যে কিছু জঙ্গির মস্তিষ্কপ্রসূত, তা পানির মতো পরিষ্কার। বার বার চর্চায় উঠে আসছে মৌলবাদী জঙ্গিদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ বাথ পার্টির সদস্যদের হাত মেলানোর কথা। আর খটকাটা শুরু সেখান থেকেই। ১৯৬৮ সালে ইরাকের ক্ষমতা দখল করে বাথ পার্টি। যে প্রক্রিয়ার অন্যতম হোতা ছিলেন সাদ্দাম হুসেন। পরে যিনি হয়ে ওঠেন ইরাকের সর্বময় কর্তা। একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের মাথা। যদিও সেই সরকার ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। অথচ সেই বাথ পার্টির সদস্যরাই আজ আইএস-এর হয়ে লড়াই করছেন, নেতৃত্বে রয়েছেন! বাথ পার্টির সদস্যরা তার লড়াই চালিয়ে যাবেন, আদালতে শুনানির সময় মাঝে-মধ্যে এমনটাই দাবি করতেন সাদ্দাম। সাদ্দামকে সরানোর কিছু দিনের মধ্যে প্রশাসন ও সেনাবাহিনী থেকে বাথ পার্টির সদস্যদের একে একে তাড়িয়ে দিয়ে সেই পথটাও প্রশস্ত করে দিয়েছে মার্কিন জোট। ফলে, জোটের বিরুদ্ধে বাথ পার্টির সদস্যদের জোট বাঁধতে দেরি হয়নি। শুরু হয়েছে রক্তপাত। কিন্তু তখনও সুন্নি মৌলবাদীদের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রশ্ন ওঠেনি। বরং দুই পক্ষ বার বার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সেই বিদ্বেষ অবশ্য এখন অনেকটাই অতীত। গোয়েন্দা মহলে দ্বিমত নেই যে, আইএস-এর এই চোখ ধাঁধানো সাফল্যের পিছনে রয়েছে বাথ পার্টির সদস্যদের সামরিক দক্ষতা। এই তেলে-জলে মিশে যাওয়ার পিছনে কী কী কারণ রয়েছে, তা নিয়ে গোয়েন্দাদের মধ্যে রয়েছে নানা জল্পনা। আইএস তৈরির প্রাথমিক পর্বে বাথ পার্টির বিক্ষুব্ধ সদস্যদের সঙ্গে ইরাকে আল-কায়েদার জঙ্গিদের যোগাযোগের সেতু তৈরি করেছিল সিরিয়ার আসাদ সরকার। কিন্তু সেই বন্ধন যে এত মজবুত হয়ে উঠবে, তা আন্দাজ করতে পারেননি মার্কিন গোয়েন্দারা। মার্কিন কূটনীতির অন্দরমহলে ধারণা ছিল, আল-কায়েদার জঙ্গিদের কড়া মৌলবাদের সঙ্গে অচিরেই ঠোকাঠুকি লাগবে বাথ পার্টির সদস্যদের। ফলে অন্তর্দ্বন্দ্বে আইএস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কিন্তু সেই আশায় পানি ঢেলে উত্তরোত্তর মহীরুহ হয়ে উঠেছে আইএস। বাথ পার্টির সদস্যদের মধ্যে মৌলবাদের বীজটি অবশ্য সাদ্দামই বুনে দিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে যাওয়া যাক আশির দশকে। যখন দীর্ঘ দিন ধরে ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল ইরাক। সেই যুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে তাকে ‘জিহাদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন সাদ্দাম। ধীরে ধীরে বাথ পার্টির সদস্যদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষাদানের কাজও শুরু হয়েছিল। বাথ পার্টির প্রধান মাইকেল আফলাকের (ধর্মে খ্রিস্টান) মৃত্যুর পরে এই ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে আরও জোর দেন সাদ্দাম। এমনকী, মৃত্যুর আগে আফলাক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলেও সাদ্দাম প্রচার করেছিলেন। সাদ্দামের এই ধর্মীয় শিক্ষাদানের ‘প্রথা’য় বড়সড় পরিবর্তন আসে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পরে। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পরে ইরাককে হাতে মারার বদলে ভাতে মারার চেষ্টা শুরু করে আমেরিকা। নানা কারণ দেখিয়ে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা ইরাকের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়। কার্যত পঙ্গু করে দেওয়া হয় ইরাকের অর্থনীতিকে। ওয়াশিংটন ভেবেছিল, এই ভাবে সাদ্দামকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যাবে। আর তার জেরে ইরাকের ভিতর থেকেই কোনও শক্তির উত্থান হবে, যা সাদ্দামকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারবে। সাদ্দামকে যতই বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হয়েছে, ততই ধর্মীয় শিক্ষাদানের পথকে আঁকড়ে ধরেছেন তিনি। ১৯৯৩ থেকে শুরু হয়েছে ‘ফেথ ক্যাম্পেন’। বাথ পার্টির সর্ব স্তরে ধর্মশিক্ষা আবশ্যক করে দেওয়া হল। কড়া সুন্নি সালাফি ইসলামের পাঠ নিতে শুরু করে দিলেন প্রশাসনের সর্ব স্তরের আমলারা। অগ্র-পশ্চাত বিবেচনা না করেই প্রশাসনের সর্ব স্তর থেকে বাথ পার্টির সদস্যদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল বলে ক্ষোভ দানা বাঁধতে সময় লাগেনি। তবে সাদ্দামের প্রশাসন ও সেনার কেষ্ট-বিষ্টুদের থেকে ক্ষোভ বেশি ছিল তরুণ-তুর্কিদের। কারণ, কর্মজীবনের শুরুতেই তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল। সেই তরুণ-তুর্কিদের একটা অংশই এখন আইএস-এর মেরুদণ্ড। প্রাথমিক বিদ্বেষ কাটিয়ে যাদের আইএসের অতি কড়া মৌলবাদে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি। কারণ, এদের রক্তে ধর্মীয় শিক্ষাকে মিশিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সাদ্দাম। সাদ্দাম জানতেন, দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে দূরে থাকা শিয়া নেতারা ক্ষমতা পেলে কী করতে পারেন। সেই ক্ষমতার প্রমত্ততায় উত্তরোত্তর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে সুন্নিরা। হাতে তুলবে হাতিয়ার। কিন্তু বাথ মতাদর্শ নয়, সেই যুদ্ধে কাজে লাগবে ধর্মীয় মৌলবাদ। এবং বাস্তব বলছে, নির্ভুল ছিল সাদ্দামের অনুমান। আর কী অদ্ভুত ভাবে সাদ্দামের পাতা সেই ফাঁদেই পা দিয়েছে এখন মার্কিন বিদেশ নীতি, ইরাকের গণতান্ত্রিক শাসক গোষ্ঠী! ত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য: ভারতীয় সাংবাদিক 

No comments

Powered by Blogger.