বিতর্কিত কূটনীতিকের দণ্ড, তিরস্কার by মিজানুর রহমান

বিতর্কিত কূটনীতিক নিউ ইয়র্কের সাবেক কনসাল জেনারেল শামছুল হককে ‘লঘু দণ্ড’ দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ১২টি অভিযোগের ৭টি পূর্ণাঙ্গ এবং একটি আংশিক সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এ শাস্তি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বহুল আলোচিত ওই কূটনীতিকের বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি এবং তার বিরুদ্ধে সরকারের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি মানবজমিনকে নিশ্চিত করেছে। সূত্র মতে, এরই মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক স্বাক্ষরিত ওই আদেশের প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এখন তা গেজেট আকারে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। রায়ে মো. শামছুল হকের দায়িত্বজ্ঞান বর্জিত আচরণকে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ‘অশোভন’ এবং গণকর্মচারী বিধিমালা মোতাবেক ‘অসদাচরণ’ উল্লেখ করে তাকে তিরস্কার করা হয়েছে। আগামী দুই বছরের জন্য উচ্চতর পদে তার পদোন্নতি স্থগিত করার দণ্ড দেয়া ছাড়াও ওই সময়ের মধ্যে তার বিদেশে পদায়ন বন্ধের আদেশ দেয়া হয়েছে। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করার নির্দেশনাও রায়ে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে শামছুল হক তার অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এরপর পদোন্নতি ও পদায়ন বন্ধ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মহাপরিচালক হিসাবে নব প্রতিষ্ঠিত একটি অনুবিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ‘আঞ্চলিক সংস্থা’ নামের ওই অনুবিভাগ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জোটগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি দেখভাল করবে।
প্রমাণিত অভিযোগগুলো: কূটনীতিক শামছুল হকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ১২টি অভিযোগের যে ৮টি প্রমাণিত হয়েছে তা-ই কেবল রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি এমন অভিযোগের বিষয়ে সেখানে একটি শব্দও লেখা হয়নি। রায়ে শামছুল হকের ক্যাডার পরিচিতি নম্বর (০০৫০) উল্লেখ করে বলা হয়- ২০১২ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালু করে। তাকে শোকজ করা হয়। প্রায় এক মাস পর তিনি শোকজের লিখিত জবাব দেন। ২০১৩ সালের ২১শে মে ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নিয়ে তিনি তার বক্তব্য দেন। ২০১৪ সালে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দেন। জুনে মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ে রিপোর্টটি দাখিল করা হয়। রায়ে বলা হয়- তদন্ত রিপোর্ট, ব্যক্তিগত শুনানিসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে ৭টি পূর্ণাঙ্গ এবং একটি অভিযোগের আংশিক প্রমাণ পেয়েছেন। তার সবগুলোর অভিযোগই নিউইয়র্কে থাকাকালে। প্রমাণিত অভিযোগগুলো হলো-
এক. নিউইয়র্কে কনসাল জেনারেল থাকাকালে কোনো গৃহকর্মী না নিয়েই তার যাতায়াত বাবদ (অতিরিক্ত হারে বিমান ভাড়া ও দৈনিকভাতা) ৪ লাখ ১ হাজার ৯শ ৩১ টাকা তুলে নেয়া।
দুই. নিউইয়র্কে সন্তানকে কলেজে ভর্তি না করেই সরকারি তহবিল থেকে ১১০০০ ডলার (অননুমোদিতভাবে, ভাউচার ছাড়া) উত্তোলন।
তিন. কল্যাণ তহবিলের সঞ্চয়ী হিসাবকে চলতি হিসাবে রূপান্তর করে প্রায় ৯ হাজার ডলারের মুনাফা থেকে সরকারকে বঞ্চিত করা।
চার. বিধি বহির্ভূতভাবে কল্যাণ তহবিল থেকে প্রায় ৮ লাখ ১১ হাজার টাকা ব্যয় করা।
পাঁচ. নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় বদলিকালে বিমান যাত্রায় প্রকৃত ভাড়ার অতিরিক্ত ৮ হাজার চারশ ডলার অগ্রিম তুলে নেয়া।
ছয়. কর্মস্থল থেকে অব্যাহতি নেয়ার পর বহিঃবাংলাদেশ ছুটি ভোগের কারণে অনিয়মিতভাবে দৈনিকভাতা ৩ হাজার ৪শ ৫৬ ডলার তুলে নেয়া।
সাত. মালামাল পরিবহন বাবদ প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অতিরিক্ত ৮ হাজার দু’শ ৫ ডলার উত্তোলন (আংশিকভাবে প্রমাণিত)।
আট. এবং সর্বশেষ তৃতীয় সন্তানের ওষুধ ক্রয় বাবদ (যা প্রাপ্য নয়) সরকারি তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন। তাকে মেডিকেল ইন্সুরেন্স পলিসিতে অন্তর্ভুক্ত করা ও তার জন্য মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ ক্রয় করা এবং ভাউচার ব্যতীত দাঁতের চিকিৎসার জন্য মিশনের তহবিল থেকে প্রায় ৬ হাজার ডলার তুলে নেয়া।
অভিযুক্তের বক্তব্য: বিভাগীয় মামলার রায় প্রকাশের পর অভিযুক্ত কূটনীতিক মো. শামছুল হকের প্রতিক্রিয়া জানতে মানবজমিনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি আদেশের কপি হাতে পাননি দাবি করে বলেন, মুখে মুখে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কথা শুনেছি। বিশাল অঙ্কের অর্থ তিনি অননুমোদিতভাবে উত্তোলন করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে তা ফেরত দিয়েছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- কিছু অংশ ফেরত হয়েছে, বাকিটা ফেরতের আইনী প্রক্রিয়া রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.