চুড়ি-ভ্যানিটি ব্যাগ প্রতীকে নির্বাচন অসাংবিধানিক by মিজানুর রহমান খান

‘আমাদের অলংকারসমূহ—এগুলো দাসত্বের প্রতীক ছাড়া আর কী?’ আমাদের নির্বাচন কমিশনকে শাবাশ দিতেই হয়। কারণ, তারা এবারের রোকেয়া দিবস (৯ ডিসেম্বর) উদ্যাপনে ‘যথাযোগ্য’ কাজ করেছে। নারীস্থান রচনার ১১০ বছর পূর্তিতে নির্বাচন কমিশন এই রাষ্ট্রের পক্ষে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে অলংকারগুলো সত্যিই নারীর প্রতীক। চুড়িকে তারা নির্বাচনী প্রতীক করেনি। চুড়ি হলো নির্দিষ্টভাবে নারীর নির্বাচনী প্রতীক। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত সুলতানাস ড্রিম-এ নয়, রোকেয়া অন্যত্র লিখেছেন, ‘কয়েদিদের জন্য নির্মিত হ্যান্ডকাফ ইস্পাতে তৈরি, আমাদেরটা তৈরি হয় স্বর্ণ ও রৌপ্যে, আমরা যাকে বলি কঙ্কণ।’ এবারের রোকেয়া দিবসের আরও একটি পরিহাস হলো, রোকেয়ার বিয়ে হয়েছিল ১৬ বছর বয়সে। সেই দিক থেকেও এই রাষ্ট্র রোকেয়ার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের ভয়ানক প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সংসদে বিরোধী দলের নেতা, অন্যতম প্রধান দল বিএনপির শীর্ষ পদে নারী থাকার সময়ে এই ঘটনা কীভাবে ঘটল?
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেছেন, ‘পুরুষ প্রার্থীকে পুতুল, গ্যাসের চুলা বা নারীর জন্য বরাদ্দ করা কোনো প্রতীক দিলে নিশ্চয়ই তাঁরা গ্রহণ করতেন না।’ আসলে ‘নারী বা পুরুষের জন্য বরাদ্দ প্রতীক বলে কি কিছু থাকা উচিত? নির্বাচন কমিশন যুক্তি দিতে পারে, তারা নির্বাচনের জন্য প্রতীক বরাদ্দ করেছে। এটা নারীর জন্য কোনো বরাদ্দ নয়। কিন্তু তাদের যুক্তি টিকবে না, কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ, তারা এই প্রতীকগুলো বেছে বেছে সংরক্ষিত আসনের নারীর জন্য নির্দিষ্ট করেছে। প্রতীকের আকাল পড়েনি। আকাল পড়েছে জ্ঞানের। এটা কোনো ছোটখাটো ভুলত্রুটি নয়, এর মধ্য দিয়ে এই রাষ্ট্রের লিঙ্গ-অসমতাই নয়, মানুষে মানুষে বৈষম্য এবং নানা ভেদাভেদ সৃষ্টি করে শোষণ ও বঞ্চনার পরিবেশ জিইয়ে রাখার কসরতেরও প্রতিফলন ঘটেছে। এটা তাই মানবাধিকারের বিষয়। নারীর মানবাধিকারের বিষয় নয়।
কারণ, যে বীর ও বিচক্ষণ পুরুষেরা এটা করেছেন, তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ আছেন, যঁারা প্রকারান্তরে সমতাবিরোধী। আইনের সমতায় তঁাদের কোনো বিশ্বাস নেই। আইনের শাসনে তঁাদের বিশ্বাস নেই। তাই এঁদের কেবল নারীবিদ্বেষী হিসেবে দেখলে প্রকৃত রোগ শনাক্ত করতে ভুল হতে পারে। কোনো রোগের চিকিৎসার অর্ধেক সাফল্য নির্ভর করে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ের ওপর। যারা চুড়ি-পুতুল নারীর জন্য চিহ্নিত করেছে, তাদের সত্যিকার অর্থে পুরুষবান্ধব বলে মনে করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারা সভ্যতা ও প্রগতিবিরোধী। তারা নারীকে নারী হিসেবেই দূরে ঠেলে না, তারা এসব করার মধ্য দিয়ে ১৬ বা তার নিচের বয়সের মেয়েদের বিয়ে দেওয়া এবং চার বিবি জোগাড়ের মতো পরিবেশ বাঁচিয়ে রাখা, তাকে আরও শাণিত করার ধান্দা করে। ফতোয়া দিয়ে নারীকে তারা অন্তঃপুরে বন্দী রাখতে চায়। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় তারা বিশ্বাস করে না। এই মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরাই যখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করে, তখন তারা কেবল নারীর জন্য বরাদ্দ লুট করে না।
এই সমাজের যাঁরা ১৬ বছরে বিয়ের বয়স নামিয়ে মধ্যযুগ নামিয়ে আনতে চান, যাঁরা নারীকে চুড়ি প্রতীক দিয়ে সর্বস্তরে, জনজীবনে নারীকে প্রতীকায়িত করতে চান, তাঁদের বোধোদয় হোক এক শতাব্দী আগেও উপন্যাস লিখতে গিয়ে মহীয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন পুরুষের প্রতি টিটকারি করেননি। রোকেয়া লিঙ্গ-সমতায় বিশ্বাসী ছিলেন না, এমন দোষারোপ তাঁকে কেউ করেনি। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন সন্দেহাতীতভাবে লিঙ্গবৈষম্য প্রদর্শনের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে, যা কেবল উচিত-অনুচিত এবং শোভন-অশোভনের বিষয় নয়। এর সঙ্গে সরাসরি সাংবিধানিক অধিকারের প্রশ্ন জড়িত। সংবিধানের কয়টি অনুচ্ছেদকে বিষয়টি আঘাত করেছে। আসুন, আমরা পরীক্ষা করে দেখি। ২৮ অনুচ্ছেদ বলেছে, নারী-পুরুষভেদের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। একজন নারীকে ভ্যানিটি ব্যাগ ও চুড়ি নিয়ে নির্বাচন করতে বাধ্য করাটা তাই এই ২৮ অনুচ্ছেদকে আঘাত করেছে। এর ২ উপদফা বলেছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী–পুরুষের সমান অধিকার থাকবে। এই সর্বস্তরের মধ্যে পৌর নির্বাচনে পুরুষ প্রতীক বেছে নিতে নারীর সম–অধিকারও নিশ্চয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। ৩১ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, দেহ ও সুনামের হানি ঘটে।’ চুড়ি, চুলা, ভ্যানিটি ব্যাগ ব্যক্তি হিসেবে কোনো নারী প্রার্থীর সুনামের হানি ঘটাতে পারে। এসব প্রতীক বেছে নিতে বাধ্য করাটা ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার (৩২ অনুচ্ছেদ) থেকে নারী প্রার্থীকে বঞ্চনা করারও শামিল। তাই এতগুলো মৌলিক অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে যে প্রতীক বরাদ্দ, তা আইনসিদ্ধ হতে পারে না। এই আইন বা বিধি সংবিধানকে আঘাত করেছে, তাই এটা চলতে পারে না। নারীদের কিংবা নাগরিকদের উচিত হবে সর্বকালের জন্য ফয়সালা করে তবেই নির্বাচনে যাওয়া।
৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীর প্রাক্কালে নারী প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন শুধু যে নারীর বিরুদ্ধাচরণ করেছে তা-ই নয়, তারা আসলে হীন মানসিকতারও পরিচয় দিয়েছে। গত মে মাসে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইঁদুর, হারমোনিয়াম, কচ্ছপ—এসব প্রতীক ঠিক করেছিল। তা নিয়ে প্রার্থীরা প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন। এক ধর্মীয় নেতার ছেলে হারমোনিয়াম পেয়ে বলেছিলেন, তাঁকে সবাই টিটকারি দেবে। আরেকজন বলেছেন, তিনি মুলা পাওয়ার পর থেকে প্রতিপক্ষ তাকে মুলি বলে। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন বলেছিল, এত প্রতীক বরাদ্দ করতে হচ্ছে তাই সবাইকে খুশি করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ইসির একজন কর্তা সংখ্যাধিক্যের দোহাই দেওয়ায় তাঁকে বললাম, এই প্রতীকগুলো সবাইকেই বরাদ্দ দিতেন। কেন নারীকেই চুড়ি বেছে নিতে হবে? পুরুষকে কেন ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে নির্বাচন করা থেকে বঞ্চিত করা হলো। এটাও তো পুরুষের জন্য বৈষম্যমূলক। পাকিস্তানে জুতার ব্রাশ, প্যান্ট, বেবিফিডার, কলা, ব্লেড ও ঝাঁটার বাঁট এবং বিহারে কাঁচা মরিচ, জুতা, চপ্পল ও আইসক্রিমের মতো তেতো প্রতীক নিয়ে নির্বাচন হয়েছে কিন্তু সেখানে নারীর প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ ওঠেনি। ইসি একা নয়, আইন মন্ত্রণালয়ও পরিচয় দিয়েছে তারা লিঙ্গ-সমতায় কতটা অসংবেদনশীল। শাড়ি-চুড়ি ধরনের প্রতীকগুলো নিয়ে বিধি জারির আগে তারা এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিয়েছে। এসব প্রতীক দ্রুত বাতিল করে নতুন করে বিধি জারি করা খুবই সম্ভব। কিন্তু যন্ত্রবৎ সময়স্বল্পতার দোহাই দিয়ে তারা তা না করলে অবাক হব না।
বেগম রোকেয়ার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলি, তাঁর স্বপ্নরাষ্ট্রই হোক বিশ্বমানবতার স্বপ্ন। পুরুষস্থানে বসে নারীস্থানের স্বপ্ন এঁকে তিনি রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। এই সমাজের যাঁরা ১৬ বছরে বিয়ের বয়স নামিয়ে মধ্যযুগ নামিয়ে আনতে চান, যাঁরা নারীকে চুড়ি প্রতীক দিয়ে সর্বস্তরে, জনজীবনে নারীকে প্রতীকায়িত করতে চান, তাঁদের বোধোদয় হোক। তাঁদের উদ্দেশে সুলতানার স্বপ্ন থেকে দুই ছত্র: ‘একজন পুরুষ মানুষের চেয়ে সিংহ শক্তিশালী কিন্তু তাই বলে সিংহ মানবজাতির ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারে না।’... ‘এমনকি তাদের মস্তিষ্ক নারীর চেয়ে বৃহৎ ও ওজনদার, তাই নয় কি?’ ‘হ্যাঁ, কিন্তু তাতে কী? একজন পুরুষ মানুষের চেয়ে একটি হাতির মস্তিষ্ক অনেক বড় ও ভারী। কিন্তু মানুষ তার ইচ্ছা অনুযায়ী হাতিকে শৃঙ্খলিত ও পরিচালিত করতে পারে।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.