এরশাদ সরকারকে ‘স্বৈরাচার’ বলি কেন? by আলী রীয়াজ

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম লক্ষণ হিসেবে অস্থিতিশীলতার কথা বলা হয়ে থাকে এবং তা যে মোটেই অতিরঞ্জন নয়, তা সবাই জানেন। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, গত ৪৪ বছরে নাগরিকদের আন্দোলনের কারণে মাত্র দুই দফা সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ঘটনা ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সেনাশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতন। এরশাদের পতন ছিল জনগণের শক্তির বিজয়। এই সপ্তাহে এই বিজয়ের ২৫ বছর পূর্তি পালিত হচ্ছে, যা আমাদের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে পেছনে তাকানোর, সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের স্মৃতিচারণার। এই বিজয় অর্জিত হয়েছে অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে, ফলে এই স্মৃতিচারণা কেবল ঘটনাপ্রবাহের নয়, বরং সেসব বীরকে স্মরণেরও সময়। এ-ও আমাদের স্মরণ করতে হবে যে এই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ের সূচনা ১৯৯০ সালের অক্টোবরে হলেও তার পেছনে ছিল ১৯৮২ সাল থেকে সূচিত অব্যাহত সংগ্রামের ইতিহাস।
কিন্তু এই সংগ্রামের কারণ কী ছিল? আশু লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার হাতবদল, এরশাদ সরকারের অপসারণ। কিন্তু এই তাগিদটি তৈরি হয়েছিল কেন? ১৯৮২ সাল থেকে ক্ষমতাসীন ওই সরকার আচরণেই কেবল স্বৈরাচার ছিল তা নয়, আকাঙ্ক্ষার দিক থেকেও স্বৈরাচারীদের অন্যতম লক্ষণ—ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী, সম্ভবত চিরস্থায়ী করা—ছিল এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এরশাদ সরকারের পতনের ঘটনা সে কারণেই যথাযথভাবে ‘স্বৈরাচারীর পতন’ বলে চিহ্নিত। এই ঘটনাবলিকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে এর ২৫ বছর পূর্তি পালনের সময়, আমাদের সুস্পষ্টভাবে এই দিকটি মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের এযাবৎ ইতিহাসে একটানা সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীন এরশাদ সরকারকে আমরা কেন ‘স্বৈরাচার’ বলে বর্ণনা করি। এই ‘কেন’ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, অন্যথায় আমরা এই আন্দোলনের যথাযথ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হব না।
স্বৈরাচারী ব্যবস্থার সুস্পষ্ট প্রামাণিক লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রশ্নসাপেক্ষ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অবৈধভাবে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠান; ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ ও ক্ষমতাসীন অবস্থায় রাষ্ট্রশক্তির নির্বিচার ব্যবহার। এটি কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বা বিশেষ কোনো সরকারের ক্ষেত্রে কার্যকর তা নয়, পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালেই এর অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে, তৎকালীন পাকিস্তানে আইয়ুব খানের ‘উন্নয়নের এক দশক’ (১৯৫৮-১৯৬৮)-এর অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে এবং যাঁরা এই ইতিহাস পাঠ করেছেন, তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন, কেন তাকে ‘স্বৈরাচারের এক দশক’ বলা হয় এবং কেন সেনাশাসক আইয়ুব খানকে স্বৈরাচারী ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ নেই। এরশাদ সরকারের ক্ষেত্রে উল্লিখিত লক্ষণগুলোই ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য।
প্রায় নয় বছরের এরশাদ শাসনের আরও কয়েকটি দিক চিহ্নিত করা দরকার, যাতে আমরা এই সরকারের চরিত্র উপলব্ধি করতে পারি। এগুলো হচ্ছে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনিক বা প্রতিনিধিত্বের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ রোধ করা এবং দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। এই প্রবণতাগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্নিরীক্ষ ছিল তা নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়। সর্বোপরি এরশাদের পূর্বসূরি জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে আমরা এর কিছু লক্ষণ দেখতে পাই, যে কারণে টেকসই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, ক্ষমতা ব্যক্তির হাতেই কেন্দ্রীভূত থেকেছে। কিন্তু এরশাদের আমলে এই প্রবণতাগুলো সরকার ও শীর্ষ ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির লক্ষ্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়। সে কারণে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সারা পৃথিবীতে ‘রিচেস্ট প্রেসিডেন্ট অব দ্য পুওরেস্ট কান্ট্রি’ (সবচেয়ে গরিব দেশের সবচেয়ে ধনী প্রেসিডেন্ট) পরিচয়ে পরিচিত হন। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে রাষ্ট্রক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তার একটি উদাহরণ হচ্ছে তৎকালীন সরকারপ্রধানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যাংক বিসিসিআই, বিশেষ করে এর প্রধান আগা হাসান আবেদির সম্পর্ক। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস-এ ১৯৯১ সালের ২ নভেম্বর প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে জেনারেল এরশাদ একটি দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিক হিসেবে বিশাল বেতনে নিয়োগ দিয়েছিলেন ব্যাংকের একজন কর্মকর্তাকে, যাতে ওই ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা হয়।
প্রায় বিস্মৃত এসব ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কারণ হলো এই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে জেনারেল এরশাদের শাসনের বিষয়টি কেবল একজন ব্যক্তির শাসনের বিষয় ছিল না। স্বৈরাচারী ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন একজন ব্যক্তি, কিন্তু স্বৈরাচারী ব্যবস্থা এই ব্যক্তিকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে সাজিয়ে তোলে, যা সবার অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে নাগরিকদের আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এটাই যে ১৯৭৫ সাল থেকে যে ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল, রাজপথের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাকে পরাস্ত করা গিয়েছিল। আন্দোলনের এই সাফল্য বিরাজমান ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন ধরনের রাজনীতির সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছিল। এরশাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা রাষ্ট্র ও সমাজের গণতন্ত্রায়ণের সম্ভাবনা। সুনির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলের কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন হয়েছিল এমন দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ওই আন্দোলন ‘স্বৈরাচারী ব্যবস্থা’কে বদলে দিতে চেয়েছিল, এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না।
এখন প্রশ্ন উঠবে, সেই সম্ভাবনার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে? ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জন বলতে আমরা দুটো বিষয়ের দিকে অঙ্গুলিসংকেত করতে পারি—তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা ও সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন। প্রথমটিকে স্থায়ী সাংবিধানিক ব্যবস্থায় রূপান্তর করার জন্য দরকার হয় আরেকটি আন্দোলন, ১৯৯৫-৯৬ সালে আমরা সেই আন্দোলনই প্রত্যক্ষ করি। বাংলাদেশের এযাবৎকালের ইতিহাসে সেটি হচ্ছে দ্বিতীয় সফল আন্দোলন। এখন এই ব্যবস্থাই কেবল অপসৃত হয়েছে তা নয়, অন্যদিকে যে প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করা সম্ভব হলে এই ব্যবস্থারই প্রয়োজন হতো না, তাও তৈরি করা হয়নি। ফলে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিবেচনায় বাংলাদেশের রাজনীতি খুব বেশি এগিয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন যে ইতিবাচক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিল, তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি কেননা এটি ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের বিকল্প হিসেবে চালু করা হয়নি। সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এক জায়গায় একত্র হয়েছে, যা কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্বোধন ঘটাতে পারেনি।
তাহলে স্বৈরাচারীর পতনের ২৫ বছর পূর্তিতে আমরা ওই আন্দোলনের কোন দিকগুলো স্মরণ করব? আমরা স্মরণ করব রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কোন কোন বৈশিষ্ট্য ও উপাদানের বিরুদ্ধে নাগরিকদের উত্থান ঘটেছিল। সেই ইতিহাস আমাদের মনে রাখা দরকার, বারবার স্মরণ করা দরকার এবং যাঁরা এই আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী ছিলেন না, তাঁদের কাছে তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.