মজমার নামে প্রতারণা, ছিনতাই by রুদ্র মিজান

‘খাউজানি, চুলকানির যন্ত্রণায় ঘুমাইতে পারেন না। আসুন আমাদের প্রচার মাইক লক্ষ্য করে। দেখুন আমাদের মলমগুলো। রাতে লাগাইবেন, সকালে উইঠ্যা টেরই পাবেন না কোথায় লাগাইছেন। যে কোনো বড় ফার্মেসিতে গেলে এর দাম নেবে ৪০ টাকা। কিন্তু কোম্পানির প্রচারের জন্য আমরা নিচ্ছি মাত্র ২০ টাকা। ২০ টাকা,  ২০ টাকা,  ২০ টাকা। আছেন কোনো দাদাভাই, নেবেন একটা পাগলা মলম?’ এ রকম নানা মলম, বেজির তেল, দাঁতের মাজন, অষ্টধাতুর আংটি, হাঁপানি, বাথ ও যৌন রোগের ওষুধ বিক্রি হয় ফুটপাথে। বিক্রি হয় সর্ব রোগের মহৌষধ তাবিজ-কবজ। এসব বিক্রির জন্য বসানো হয় মজমা। প্রতিদিনই রাজধানীর গুলিস্তানসহ বিভিন্ন এলাকায় এ রকম শতাধিক মজমা বসে। মজমা জমানোর জন্য নানা ঢঙে বক্তব্য দেন ক্যানভাসাররা। সাদা চোখে এইটুকু সবাই দেখে থাকলেও ভেতরে রয়েছে আরও নানা রহস্য। মজমার পাল্লায় সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকে। কখনও প্রতারণা করে, কখনও ছিনতাই করে লুটে নেয়া হচ্ছে সহজ-সরল মানুষদের টাকা।
মজমা দেখতে গিয়ে কয়েকদিন আগে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের ব্যবসায়ী কবির হোসেন। তিনি জানান, সময় তখন বিকাল ৪টা। তাগদা শেষে টাকা নিয়ে ফিরছিলেন। এ সময় গুলিস্তানের আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে মজমা দেখে কৌতূহল নিয়ে দাঁড়ান তিনি। মুগ্ধ হন ক্যানভাসারের বক্তব্যে। নানা রোগের ওষুধ হিসেবে তাবিজ বিক্রি করছিলেন ক্যানভাসার। উৎসাহী হয়ে একটি তাবিজ কিনেন তিনি। ক্যানভাসার তখন কানের কাছে গিয়ে জানতে চান তার সমস্যার কথা। জানার পর বলেন, আপনি থাকবেন। মজমা শেষে এ বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দেবো। এটা কঠিন কিছু না। চিন্তা করবেন না। মজমা শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পার্শ্ববর্তী জাতীয় নাট্যমঞ্চের এক পাশে। সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে বোতলে করে পড়া পানি, তাবিজ ও কয়েকটি মাটিতে পুঁতে রাখার জন্য গাছের মূল দেয়া হয়। বিনিময়ে দুই হাজার একশ’ টাকা দাবি করেন ওই ক্যানভাসার। কবির টাকা দিতে অসম্মতি জানালে বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হয়। এ সময় আরও তিন যুবক এসে কবিরের সঙ্গে থাকা কয়েক হাজার টাকা লুটে নিয়ে যায়। কবিরের ধারণা ওই তিন যুবক ক্যানভাসারের লোক। পরিকল্পিতভাবেই ছিনতাই করার জন্য ফুসলিয়ে তাকে নাট্যমঞ্চের এক কোনে নিয়ে যাওয়া হয়।
এসব মজমা থেকে তাবিজ, ওষুধ কিনে অর্থ অপচয় শুধু না নিজের শারীরিক ক্ষতিও করেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে একজন খিলগাঁওয়ের তালতলার আফরোজ মিয়া জানান, স্বাস্থ্য কমানোর জন্য ওষুধ নিয়েছিলেন তিনি। ওষুধ খাওয়ার পর অস্বাভাবিকভাবে শরীর থেকে মলমূত্র, পানি বের হতে থাকে। পরবর্তীতে একটি বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি করা হয় তাকে। কয়েক মাস চিকিৎসা করে তবেই সুস্থ হয়েছেন তিনি। শুধু আফরোজ মিয়া না এরকম ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা দীর্ঘ।
জানা গেছে, শাহ্‌জালাল, বাবুল আখন্দ, সেলিম, রাসেলসহ প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি গুলিস্তান এলাকার এই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে বাবুল আখন্দসহ কয়েক জনকে প্রতারণার দায়ে ইতিমধ্যে দণ্ড প্রদান করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারপরও থেমে নেই তাদের প্রতারণা। এখান থেকে স্থানীয় একটি গ্রুপ রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। শ্রমিক লীগের নাম ভাঙিয়ে সোহেল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে বনশ্রীর কামালসহ কয়েক ব্যক্তি চাঁদা আদায় করে থাকেন এসব মজমা থেকে। একইভাবে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অর্থের বিনিময়ে তাদের বসতে দেয়া হয়। ফুটপাত দখল করেই প্রতিদিন মজমা বসে ওই এলাকায়। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের।
সরজমিন দেখা গেছে, মজমা বসানোর শুরুতেই আশপাশের লোকজনকে বিভিন্ন পন্থায় আকৃষ্ট করা হয়। কখনও কখনও গান করা হয়। এরমধ্যেই আকর্ষণীয় ঘোষণা দেয়া হয়। সরজমিন দেখা গেছে,  আহাদ পুলিশ বক্সের পাশেই বসেছে মজমা। সেখানে রফিক নামের এক ক্যানভাসার বক্তব্য দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, ভাইয়েরা আপনারা কখনও গলাকাটা কবুতর উড়তে দেখেছেন। দেখেন নাই। আমরা তা দেখাবো। আমার ওস্তাদ ভারত ও জাপান থেকে যাদুবিদ্যা শিখেছেন। তিনি আপনার সামনে এই যাদু দেখাবেন। তার রয়েছে আরও অনেক গুণ। দেশ-বিদেশে জটিল অনেক রোগীকে সুস্থ করেছেন তিনি।... এভাবেই মূল উদ্দেশ্যের দিকে যাত্রা করেন। একপর্যায়ে ওস্তাদ নিজে হাজির হন। তার পরনে লাল রঙের পাঞ্জাবি, মাথায় একই রঙের টুপি। গলায় নানা ধরনের মালা ঝুলানো। হাতে নানা রকম আংটি। তিনি আবার আকর্ষণ করার জন্য গলাকাটা কবুতর উড়ানো হবে বলে ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে যৌন সংশ্লিষ্ট নারীদের ছবি দেখাতে থাকেন। বলতে থাকেন যৌন সমস্যার কারণে কিভাবে সংসার ভাঙে। এইসব সমস্যা সমাধানে ইচ্ছাই যথেষ্ট। সমবেতরা আরও আকৃষ্ট হয়। একপর্যায়ে নিজের তাবিজ বিক্রির ঘোষণা দেন। যৌনরোগ, স্বপ্নদোষ, লিভারের সমস্যা, গ্যাস ও মাথাব্যথা, ভয়-ভীতিসহ জটিল ও কঠিন রোগের সমাধান দিতে সক্ষম এই তাবিজ। এটি ব্যবহারের মাধ্যমে আশ্চর্য ক্ষমতাবলে-পীর সাহেবের দোয়ায় সব সমস্যার সমাধান হবে। তবে টাকা তিনি নিবেন না। মূল্য ২০ টাকা জমা দিবেন বাবার দরবারে। তবে কেউ যদি আরও বেশি দেন তা তিনি রেখে দিবেন। এরমধ্যেই বুঝে নেন কোন ব্যক্তির কাছে বেশি টাকা রয়েছে। সূত্রমতে, তুলনামূলক বেশি টাকা সঙ্গে রয়েছে এমন ব্যক্তিকে টার্গেট করা হয়। নানা কৌশলে তার সমস্যা সমাধানের কথা বলে সর্বস্ব লুটে নেয়া হয়। কখনও ফুসলিয়ে ওষুধ, তাবিজ বিক্রি করে। কখনও ছিনতাইয়ের শিকার হন ওই ব্যক্তি। প্রায়ই ঘটছে এসব ঘটনা। তবে ছিনতাইয়ে মজমা আয়োজনকারীরা জড়িত না বলেই দাবি করেন তারা। আবুল হোসেন নামে এ কজন বলেন, তিনি মজমা আয়োজন করেন। যৌন রোগের ওষুধ ও তাবিজ বিক্রি করেন। জোর করে কারও টাকা নেন না। তবে মজমার নামে কেউ কেউ ছিনতাইকারীদের দিয়ে অনেকের টাকা লুটে নেয় বলে শুনেছেন তিনি। এরকম শতাধিক চক্র রয়েছে রাজধানীতে। তারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মজমা বসিয়ে অবৈধভাবে ওষুধ বিক্রি থেকে শুরু করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ড্রাগ সুপার গোলাম কিবরিয়া বলেন, ওষুধ বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়। নির্দিষ্ট ওষুধের দোকান ছাড়া ওষুধ কোথাও বিক্রি করা অবৈধ। এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই অভিযান চালানো হয় বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, প্রতারণার শিকার হয়েছেন এ রকম কেউ অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.