বিদেশিদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা

জননিরাপত্তায় রাজধানীতে পুলিশি পাহারা
বেশ কয়েকটি উন্নত ও ধনী দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কসংকেত জারি করেছে। মাত্রার হেরফের আছে বটে। তবে অনেকেরই ভাবসাব যে আমাদের দেশটা জঙ্গিতে ভরে গেছে। যেকোনো সময় তাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। এসব আশঙ্কা একেবারে অমূলক, এমনটা বলা যাবে না। সাম্প্রতিক কালে সন্ত্রাসী হামলায় দুজন বিদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। প্রাণনাশী হামলা হচ্ছে কিছু ব্লগারের ওপর। ভিন্নধর্মাবলম্বী ধর্মীয় নেতারাও কেউ কেউ এর শিকার হচ্ছেন। হুমকি এসেছে অনেকের কাছে। এমনকি মুসলমানদের একটি অংশ শিয়া সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা হচ্ছে। আরও দুঃখজনক যে এ হামলাগুলো হচ্ছে ইসলামের নামে। এসব ঘটনায় গুটিকয় স্বার্থান্বেষীকে বাদ দিলে গোটা দেশবাসী মর্মাহত। ঘটনার হোতাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত বিচার সবারই কাম্য। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এ বিষয়ে কিছুটা প্রচেষ্টাও নিচ্ছে। তবে সেটা আরও জোরদার ও তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর এটা অসম্ভবও নয়। কিন্তু এ বিষয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও এমনটা বলা যাবে না যে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্ক করার যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। মাত্র কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল জঙ্গি হামলার আশঙ্কার কথা বলে তাদের নির্ধারিত ও সব প্রস্তুতি নেওয়া সফরসূচি বাতিল করে। আবার এর কিছুকাল পরেই তাদের ফুটবল দল এখানে এসে খেলে যায়। বরাবরই এ ধরনের খেলোয়াড়দের জন্য সরকার বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়। সাম্প্রতিক কালের ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে তা জোরদারও করা হয়েছে। এতে তাদের আশ্বস্ত থাকার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে দেশটি অতিসম্প্রতি তাদের সব স্বেচ্ছাসেবককে বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে বলেছে। দূতাবাসকে নির্দেশ দিয়েছে তাদের জনবল ছেঁটে ফেলতে। এতে আমরা শুধু দুঃখিত বললে কম বলা হবে। বরং ক্ষুব্ধও। প্রশ্ন আসে, সব দেশের ক্ষেত্রেই কি তারা এমনটা করে? কয় দিন আগে প্যারিসে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটল, তা গোটা বিশ্ববাসীর জন্যই বেদনাদায়ক। আমরাও এর অংশীদার। সে নগরে তো আইএস নামক জঙ্গি সংগঠনটি নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে এমনটা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে হামেশাই খুনখারাবি হয়। এই সেদিনও ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি হলিডে পার্টির ওপর তিনজন বন্দুকধারীর গুলিতে ১৪ জন নিহত হন। সেখানে মাঝেমধ্যে স্কুলে ঢুকেও গুলি করে বাচ্চাদের মেরে ফেলে কেউ কেউ।
সংবাদপত্র সূত্র থেকে জানা যায়, সে দেশে শুধু এ বছরই ৩৫৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে জোর দাবি থাকলেও অস্ত্র উৎপাদনকারীদের লবিং এটা হতে দিচ্ছে না। বছর কয়েক আগে মুম্বাইয়ের একটি হোটেলসহ নগরের অংশবিশেষ লম্বা সময় মাত্র কয়েকজন দুর্বৃত্তের নিয়ন্ত্রণে ছিল। খুন হয়েছে অনেক। প্যারিস হামলার পরেই সেখানে একটি শীর্ষ সম্মেলন হয়ে গেল। হওয়ারই কথা। যত বেদনাদায়কই হোক, কোনো দুর্ঘটনার জন্য তো সব স্থবির হয়ে যায় না। আর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে প্রতিদিন হাজার হাজার বিদেশি নাগরিক যাচ্ছেন। যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশের সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি, এমনকি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরাও। এটা তো স্বাভাবিক। হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ফ্রান্সসহ ইউরোপের দেশগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থা আমাদের তুলনায় অনেক জোরদার। তাদের বিত্ত-সামর্থ্য বিবেচনায় তাই হওয়ার কথা। তবে সে নিরাপত্তাব্যবস্থার মাঝেই তো ঘটনাগুলো ঘটছে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের ঘটনা সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে আগাম সবকিছু জানার সুযোগ নেই। এর ফলেই এমনটা ঘটে। এ কথাটা আমাদের জন্যও প্রযোজ্য। তবে তারা দ্রুত অপরাধী শনাক্তকরণ ও বিচারের আওতায় আনতে সক্ষম হয়। আর আমাদের এখানে এর ঘাটতি যথেষ্ট। তা ছাড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ–জাতীয় ঘটনার তদন্ত ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্নমুখী করা হয়। যেমনটা ঘটেছিল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায়। এখনো এমন কিছু ঘটবে না এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। আর তা ঘটলে প্রকৃত অপরাধী আড়ালে থেকে যায়। সুযোগ পায় নতুন করে অপরাধ ঘটানোর। তা ছাড়া প্রকৃত সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতেও সময়ক্ষেপণ হয় কারণে-অকারণে। এসব করেই আমরা অন্য দেশগুলোকে আমাদের বিষয়ে বিরূপ ও অপমানজনক মন্তব্য করা ও ব্যবস্থা নিতে সুযোগ দিচ্ছি। আর তারাও বিবেচনাহীনভাবে বা ভিন্ন কোনো বিবেচনা থেকে আমাদের মতো দেশকে অপদস্থ করার সুযোগ হাতছাড়া করে না। এ দেশে আইএস নামক জঙ্গি সংগঠন আছে কি নেই—এ নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্ক।
সেটা থাকুক বা না থাকুক, আমাদের এখানেও জঙ্গি তৎপরতা চলছে এবং তা দ্রুত দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা না করলে ডালপালা মেলে অধিকতর বিপদ ডেকে আনতে পারে। তবে ইউরোপে আইএস যে সক্রিয় সে প্রমাণ তো আমরা সেদিনই দেখলাম। আর আইএস কাদের সহায়তায় গঠিত এবং এর সুবিধাভোগী কারা এটা নিয়ে তো অনেক খোলামেলা কথাবার্তাই হচ্ছে। অন্তত আমাদের মতো দেশ এ বিপজ্জনক খেলায় নামেনি সেটা নিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রও তার নাগরিকদের আমাদের দেশ ভ্রমণে সতর্ক করেছে। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে সে দেশের সরকারের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ নেতিবাচক। তবে তাদের সুশীল সমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিল, এটা ভুলে যাওয়ার নয়। এককেন্দ্রিক বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা অনেক। তা ছাড়া তাদের কিছু কিছু পরামর্শ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার দাবি রাখে। যেমন, গত জাতীয় নির্বাচনটি সাংবিধানিকভাবে বৈধ হলেও রাজনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল। একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সে দুর্বলতা কাটানোর একটি পথ। তবে ইউরোপের কিছু দেশ এমনকি জাতিসংঘ আমাদের মানবাধিকার প্রশ্নে প্রায়ই যেসব কথা বলে, তা তর্কাতীতভাবে মেনে নেওয়া যায় না। মানবাধিকার দেশ, কাল ও স্থানভেদে ভিন্ন মাত্রা পায়। ইউরোপ প্রাণদণ্ড রদ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্য তা করেনি। করেনি জাপান, চীন ও ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত অনুরাগী মিসর ও সৌদি আরব শত শত লোককে প্রাণদণ্ড দিয়ে থাকে। মিসরে সামরিক বাহিনী তাদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রাণদণ্ড দিয়েছে। অবশ্য দণ্ড কার্যকর হয়নি এখনো। এসব ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কোনো জোর প্রতিবাদ করেছে এমনটা আমরা জানি না। আমাদের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনাই ঘটে থাকে। এগুলো নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছে ও হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশও সে বিষয়ে কথা বললে অযৌক্তিক বলা যাবে না। তবে এসব বলতে নিজেদের অবস্থানটি একটু দেখে নিলে ভালো হয়। গুয়ানতানামো বে কারাগারে আটক যুদ্ধবন্দীদের জেনেভা কনভেনশনে স্বীকৃত সুবিধাদির কিছুই দেওয়া হয়নি। বরং সেখানে বছরের পর বছর চলেছে অমানবিক নির্যাতন। হতে পারে ওসামা বিন লাদেন ছিল সন্ত্রাসী নেতা।
আমাদের অনেকের মাঝেই তার জন্য কোনো সহানুভূতি নেই। তবে তারও আইনের আওতায় বিচার পাওয়ার অধিকার ছিল। কিন্তু তা মেনে নেওয়া হয়নি। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অগোচরে সে দেশে সশস্ত্র হামলা করে তার মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয়। অবশ্য তারা এগুলো করেছে বলেই আমরাও মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে থাকব, এমন কোনো কথা নয়। পাশ্চাত্য বিশ্বের কাছে আমরা অনেকভাবে ঋণী। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে তারা সমৃদ্ধ করছে আমাদের জনসম্পদকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা ত্বরান্বিত করছে উন্নয়নের গতি। বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে তাদের দেশে। তাঁরা পেয়েছেন সমৃদ্ধ জীবনের স্বাদ। এ ছাড়া বিপন্ন মানবতার ডাকে ওই দেশগুলো লক্ষণীয়ভাবে সাড়া দেয়। সম্প্রতি সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া শরণার্থীদের ইউরোপই আশ্রয় দিয়েছে উদারভাবে। অথচ তাদের জনশক্তি আমদানি করতে হয়। আমাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার হিসেবেও ইউরোপ আর আমেরিকা সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ওপর নির্ভর করতে হয় আমাদের। তবে একটি জাতির আত্মসম্মান অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সেটি তাদের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি প্রযোজ্য আমাদের ক্ষেত্রেও। অবশ্যই আমরা তাদের পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেব। আর তাদেরও কারণে-অকারণে আমাদের হেয় করার পথ থেকে দূরে থাকতে হবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.