দেড় মাসে ১০ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা

হোসেনী দালানে বোমা হামলা - ফাইল ছবি
দেড় মাসে ১০ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলায় হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় হামলাকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটলেও এর কোনো কিনারা করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অত্যন্ত নিখুঁত পরিকল্পনায় হামলা হওয়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে পরিকল্পনাকারীরা। নিরাপত্তা ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর হামলা সন্ত্রাসের নতুন রূপ। এর আগে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরাও এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েননি। তাই তাদের উচিত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করা। তা না করতে পারলে এ ধরনের ঘটনা  রোধ করা যাবে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় জঙ্গি সংগঠনের পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করা হলেও সরকারের তরফে বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব বাংলাদেশে নেই। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা ছাড়াও সম্প্রতি হামলার শিকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিক। আক্রান্ত হয়েছে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দিনাজপুরে একটি মন্দিরে ও ঢাকায় এক খ্রিষ্টান পরিবারে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রাত সাড়ে ৮টায় ডাবোর ইউনিয়নের জয়নন্দ গ্রামে দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) মন্দিরে বোমা হামলা ও গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ সময় মন্দিরে কীর্তন, ধর্মসভা চলছিল। এ ঘটনায় সন্দেহমূলক দুইজনকে আটক করা হয়েছে। কাহারোল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনসুর রহমান জানান, ঘটনার ক্লু উদঘাটনের জন্য তদন্ত চলছে। এর কয়েক দিন আগে গত ৫ই ডিসেম্বর একই উপজেলায় কান্তজিউর মন্দির প্রাঙ্গণে রাসমেলার একটি যাত্রা প্যান্ডেলে ককটেল হামলার ঘটনা ঘটে। রাত ১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় পরপর তিনটি বিস্ফোরণ হয়। এতে অন্তত ১০ জন আহত হন। ওই ঘটনারও ক্লু উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। যদিও সন্দেহমূলকভাবে পাঁচ জনকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
গত ৫ই অক্টোবর ঈশ্বরদীর ব্যাপটিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড’ এর পাদরি লুক সরকারকে শহরের নিজের ভাড়া বাসায় গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনার পর অজ্ঞাত কয়েক জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। হামলার পর লুক সরকার জানান, ধর্মীয় কারণেই তার ওপর হামলা হয়েছে। ওই এলাকায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর এর আগে হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। ঘটনার সময় সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রার্থনা করছিলেন তিনি। এ সময় তিন ব্যক্তি ঘরে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার গলা কাটার চেষ্টা করে। তার আগে পরিবারের অন্য সদস্যদের পাশের একটি কক্ষে আটকে রাখে তারা। এ ঘটনায় ছয় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিমান কুমার দাস জানান, এ পর্যন্ত সাত জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই জেএমবি সদস্য ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তারা প্রত্যক্ষভাবে এ ঘটনায় জড়িত বলে জানান তিনি।
গত ১৮ই নভেম্বর ফাদার পিয়েরো পারোলারি (৫০) নামে এক ইতালীয় নাগরিককে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। দিনাজপুর শহরের মির্জাপুর বিআরটিসি বাস ডিপোর সামনে সকাল পৌনে ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পিয়েরো পারোলারি পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনি শহরের সুইহারী কাথলিক মিশন চার্চের ফাদার। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে দিনাজপুর মিশনে কর্মরত রয়েছেন। এ ঘটনায় জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মাহবুব আলম ভুট্টুসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি’র উপ-পরিদর্শক বজলুর রশীদ জানান, তদন্ত চলছে। এখনও এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মাহবুব আলমকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও বাকি দুইজনকে এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি বলে জানান তিনি।
গত ২৬শে নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জের হরিপুরে শিয়া মুসলিমদের আল মোস্তফা মসজিদে দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলিতে একজন নিহত এবং তিনজন আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মুসল্লিরা তখন নামাজ আদায় করছিলেন। তারা যখন সিজদায় তখন তিন যুবক গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার কোন ক্লু উদঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ঘটনার পর আইএসের পক্ষ থেকে এ হামলার দায় স্বীকার করা হয়। ঘটনার পর পুলিশ সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করলেও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য উদঘাটনের খবর দিতে পারেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল বলেন, তদন্ত চলছে। শিগগিরই ঘটনার ক্লু উদঘাটন ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হবে।
গত ২৫শে নভেম্বর সন্ধ্যায় রংপুরের ব্যাপটিস্ট চার্চ সংঘের ফাদার রেভারেন্ড বার্নাবাস হেমব্রেম জানান, তিনিসহ দশজন খ্রিষ্টান ধর্মীয় পাদরি  এবং এনজিও কর্মীকে চিঠির মাধ্যমে হত্যার হুমকি দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে বলা হয়েছে, যা খাওয়ার খেয়ে নেন, তারপর আপনাকে পৃথিবী  থেকে যেতে হবে। যারা খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার করে তাদের এক এক করে হত্যা করা হবে। এ বিষয়ে রংপুরের পুলিশ সুপার আবদুর রাজ্জাক বলেন, হুমকি দাতাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। সেই সঙ্গে হুমকির শিকার পাদরিদের নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে।
গত ২৩শে অক্টোবর বোমা হামলায় রক্তাক্ত হয় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল। হামলায় মারা যান দুই জন। আহত হন শতাধিক মানুষ। এ ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা করে পুলিশ। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার সন্দেহভাজন আসামি আলবানী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে  দারুসসালাম এলাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়। মহররমের রাতে পুরান ঢাকায় শিয়া ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় ‘ইমামবাড়া’ হোসেনি দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে গভীর রাতে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। শিয়া সম্প্রদায়ের চারশো বছরের ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিলে আগে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে রংপুরে কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের চৈতারমোড়ে গত ১০ই নভেম্বর মধ্যরাতে মাজার শরিফের খাদেম রহমত আলীকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মাসুদ রানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানান কাউনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, মাসুদসহ দুইজনকে আটক করা হয়েছে। অপর আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও ঢাকায় বাড্ডা এলাকায় পীর খিজির খান, রাজাবাজারে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব নুরুল ইসলাম ফারুকী, গোপীবাগে কথিত পীর লুৎফুর রহমানসহ ছয়জনকে হত্যার ঘটনা ঘটে।
গত বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকার তেজগাঁও থানার মহাখালীর আরজতপাড়ার ২৬ নম্বর বাড়িতে এক খ্রিষ্টান পরিবারের সদস্যদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। দুর্বৃত্তরা বাসার গ্রিল কেটে ভেতরে ঢুকে গুলি বর্ষণ করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ওই পরিবারের তিনজনকে আহত করেছে। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, খ্রিষ্টান হওয়ার কারণেই তাদের উপর এই হামলার ঘটনা ঘটেছে। যদিও পুলিশ মনে করছে এটি ডাকাতির ঘটনা। এ বিষয়ে পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ঘটনাস্থল আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা চালাচ্ছে পুলিশ। এটি ডাকাতির ঘটনা বলেই মনে করেন তিনি।
একের পর এক এ ধরনের হামলার ঘটনায় উদ্বিগ্ন নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরাও।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইন্সটিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, এসব হামলা যারা করে তারা ইসলাম ধর্মের শিয়া সুন্নির যে ন্যাচারাল ভাগ রয়েছে তা তারা মূল্যায়িত করে না। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির দেশ। মৌলবাদীরা এই সম্প্রতি নষ্ট করতে চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। এসব চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে বাংলাদেশে দুর্বৃত্তরা বড় ধরনের সহিংসতা করতে পারবে না বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক মহা পরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা। তিনি বলেন, এসব ঘটনা রোধে গোয়েন্দা নজরদারি আরও বাড়ানো দরকার। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সজাগ ও সতর্ক হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, জঙ্গিবাদ একটি আন্তর্জাতিক সংকট। তবে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড নেই। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা অনেক সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে। আমাদের পুলিশ এর আগে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেনি। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের আরও আধুনিক করে গড়ে তোলা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.