বসতবাটি রক্ষা করা কি উন্নয়নবিরোধী?

আন্দোলনে হবিগঞ্জের চা–শ্রমিকেরা
চান্দপুরের চা-শ্রমিকেরা ১৮৯০ সাল থেকে বংশপরম্পরায় যে জমি চাষাবাদ করে আসছেন, আজ হঠাৎ করে সেই জমি থেকে তাঁরা উচ্ছেদ হতে চলেছেন! সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর চা-বাগানের তিন ফসলি ধানিজমি ও বসতভিটা উচ্ছেদ করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করবে। হঠাৎ করে নিজের বসতি থেকে উচ্ছেদ হতে যাওয়া মানুষগুলো সংগত কারণেই জানতে চায় ভূমির ওপর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় কীভাবে? কীভাবে মালিকানা তৈরি হয় জবরদখলকারী বেজার (অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ) কিংবা ব্রিটিশ কোম্পানি ডানকানের! এই সেই কোম্পানি, যে ১৫০ বছর আগে ক্ষমতার জোরে লিজের নামে হাজার হাজার একর ভূমি দখলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষগুলোকে দাসে পরিণত করেছিল। তাই দাসদের ভূমি হারানোর ব্যাপারটি তাদের কাছে কোনো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না। তা ছাড়া উচ্ছেদকৃত জমিতে যেহেতু চা-গাছ নেই, তাই তাদের কোনো লোকসানের ভীতিও নেই। আমরা বুঝতে পারি যে ডানকানের সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই সরকার এটা করেছে। অন্যদিকে ১২৫ বছর আগে যারা জঙ্গল কেটে এই ভূমিকে আবাদযোগ্য জমি হিসেবে গড়ে তুলল এবং বংশানুক্রমে শ্রম ও ঘাম দিয়ে ফসল ফলাল, তারা এর মালিক নয় কি! ভূমির মালিকানা নির্ধারণ হবে কিসের ভিত্তিতে? আমরা জানতে চাই, এই মানুষগুলোর সঙ্গে আলোচনা-বোঝাপড়া কিংবা তাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করার কোনোই কি দরকার নেই? নাকি সেটুকুর প্রয়োজন এ সরকার বোধ করে না। চা-শিল্পের জন্মলগ্ন থেকে সাঁওতাল, রাজবংশী, ওঁরাও, মাঝি, ভূমিজসহ আরও বেশ কিছু নৃগোষ্ঠী ও জাতির বসবাস এই বাগানগুলোতে। প্রায় ১৫০ বছর ধরে তারা বসতি স্থাপন করেছে। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে এত দীর্ঘ সময় ধরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা এখন অনেক কম। জীবিকার তাগিদে মানুষকে সব সময় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হচ্ছে। আজ এই চা-শ্রমিকদের আর্থসামাজিক অবস্থাটা আলোচিত হওয়া সময়ের প্রয়োজন। আমাদের চা-শ্রমিকেরা শোষণের শিকার হয়ে আসছেন। বাংলাদেশে প্রায় স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে সোয়া লাখ চা-শ্রমিক রয়েছেন। গত ১ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখ থেকে চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৮৫ টাকা দেওয়ার কথা এবং রেশনসহ তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫০ টাকা। কিন্তু সেই আগের ৭৯ টাকাই শ্রমিকেরা পাচ্ছেন। মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করতে গিয়ে নির্যাতন সহ্য করে দৈনিক ছয় টাকা বৃদ্ধির যে চুক্তি আদায় হয়েছিল, তা-ও আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। একজন চা-শ্রমিককে দৈনিক ২৩ কেজি চা উত্তোলন করতে হয়। ২৩ কেজি থেকে ১ কেজি কম উত্তোলন করলে দ্বিগুণ টাকা কেটে রাখে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার কিংবা সংগঠিত হওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার নেই বললেই চলে। চা-শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ নেই, চিকিৎসা থেকে তাঁরা বঞ্চিত। যেন একজন চা-শ্রমিকের সন্তান চা-শ্রমিক হওয়ার জন্যই জন্মায়। ১৫০ বছর ধরে তাঁরা এই চক্র থেকে বের হতে পারেননি।
তাঁদের ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় শোষণ-শাসন অব্যাহত রয়েছে। বাগানের মধ্যে চাষাবাদযোগ্য ভূমি ‘ক্ষেতল্যান্ড’ নামে পরিচিত। যে ‘ক্ষেতল্যান্ড’ আজ চা-শ্রমিকদের প্রাণ ও জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত। এমন ভূমিতেই তাঁরা চাষাবাদের মাধ্যমে কোনোরকমে বাঁচেন বসত করে। এবার মড়া চা-শ্রমিকদের উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এসেছে ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’। চান্দপুর চা-বাগানের ৫১১ একর জমি বেজার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী কৃষিজমি রক্ষা করেই অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার কথা। হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইতিমধ্যে বলে দিয়েছেন, চা-শ্রমিকেরা এত দিন ধরে সরকারি জমিতে অবৈধভাবে চাষাবাদ করছেন। উল্লেখ্য, ভূমি মন্ত্রণালয় তিন ফসলি আবাদি জমিকে অকৃষি খাসজমি হিসেবে দেখিয়ে এই বন্দোবস্তের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। রেকর্ড সংশোধন করে তারা গত ২১ নভেম্বর এ জমি বেজার কাছে হস্তান্তর করে। চা-বাগানের জমি অন্য কাজে ব্যবহার করার আইনগতভাবে ভিত্তি নেই। সরকার সেটা অমান্য করে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার নানান প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যস্ত। এর মধ্য দিয়ে শুধু চা-শ্রমিকদের জীবনই বিপন্ন নয়, চা-শিল্পও আজ চরম হুমকির মুখে। অথচ চা একটি রপ্তানিমুখী খাত এবং বাংলাদেশের বাজারেও চা একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। চান্দপুরে ‘জোন’ হলে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে ১ হাজার ৯৫৫ জন শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের প্রায় আট হাজারের ওপরে মানুষকে ভূমিহীন হয়ে পথে বসতে হবে। বাধ্য হয়ে চান্দপুর বেগমখান, রামুগঙ্গা ও জায়ালভাঙ্গার হাজার হাজার শ্রমিক রাস্তায় নেমে এসেছেন। ১২ ডিসেম্বর জমি অধিগ্রহণের জন্য গেলে চা-শ্রমিকদের প্রতিরোধের মুখে তা করতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। এখন পর্যন্ত অবস্থান, কর্মবিরতি, সমাবেশের মধ্য দিয়ে চলছে তাঁদের আন্দোলন। প্রতিদিন কোনো না-কোনো কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে কয়েক হাজার শ্রমিক তাঁদের ভূমি রক্ষার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। ইদানীং একটা উপাধি বেশ ব্যবহৃত হচ্ছে, তা হলো ‘উন্নয়নবিরোধী’। মানুষকে তার ভিটেমাটি থেকে সমূলে উচ্ছেদ করা হবে, প্রাণ-প্রকৃতি উজাড় করা হবে, কিন্তু এর বিরোধিতা চলবে না! যদি কেউ দেশের প্রচলিত আইনের কথা বলে, যদি মাটির দোহাই দেয়, কেউ যদি অধিকারের কথা বলে, বনভূমি-জলা-বসতভিটা রক্ষার দাবি তোলে, তারাই নাকি ‘উন্নয়নবিরোধী’। যে উন্নয়ন মানুষকে বাদ দিয়ে, যে উন্নয়নের নাম উন্মুক্ত কয়লাখনি যা দিগন্তজোড়া উর্বর ভূমিকে মরুভূমিতে পর্যবসিত করবে, যার নাম টিপাইমুখ বাঁধ কিংবা সুন্দরবনের ফুসফুসে যে উন্নয়ন কয়লা পোড়া চিমনির ধোঁয়া, সেই উন্নয়ন কার জন্য? রবি ওঁরাও—যিনি চান্দপুর বাগানের দুই হাজার শ্রমিকের একজন। তিনি বলেছেন, তাঁর মাতৃসম ভূমি তিনি ছাড়বেন না, কেউ কেড়েও নিতে পারবে না। এখন এই মানুষগুলোকে কি উন্নয়নবিরোধী আখ্যা দেবেন, নাকি তাঁদের ভূমির অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবেন?
জলি তালুকদার: শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক।
joly_talukder@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.