ভূরাজনীতিতে রাশিয়ার পুনরুত্থান

সিরিয়ায় রুশ সেনা
২০১৫ সালের প্রধান আন্তর্জাতিক ঘটনা কী, এই প্রশ্নের জবাব পণ্ডিতেরা তিনভাবে দিয়েছেন: ইসলামি জঙ্গিবাদ ও আইসিস, ইউরোপের উদ্বাস্তু সংকট ও রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন। তিনটি ঘটনাই একে অপরের সঙ্গে জড়িত এবং এগুলোর অভিন্ন উৎস মধ্যপ্রাচ্য। এ কথা অবশ্যই রাশিয়ার ক্ষেত্রে সত্য, মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলিকে ঘিরেই রাশিয়ার পুনরুত্থান। কিন্তু রুশ ভালুকের এই প্রত্যাবর্তন শুধু একটি ঘটনা, না এর সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য রয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন মুখ্যত সামরিক অর্থে। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় তার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল, সে অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। তা সত্ত্বেও ‘পরিকল্পিত ঝুঁকি’ নিয়ে রাশিয়া সামরিকভাবে তার পেশির ভাঁজ দেখানো শুরু করেছে।
ব্যাপারটা ওয়াশিংটনের নজরে পড়েছে। মাস দু-এক আগে মস্কো সরকারিভাবে ঘোষণা করে, হাজার কোটি ডলার খরচ করে রুশ সামরিক বাহিনীর নতুন ‘কমান্ড সেন্টার’-এর উদ্বোধন করা হয়েছে। সরকারিভাবে বলা হয়, এই সেন্টার শুধু আমেরিকার কমান্ড সেন্টারের সমতুল্যই নয়, তার চেয়ে তিন গুণ উত্তম। চলতি সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস রুশ সূত্র উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, গত এক বছরে মস্কো তার সামরিক বাজেটে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ করেছে। একই সময়ে প্রায় এক লাখ সৈন্যবহর নিয়ে সে ব্যাপক সামরিক মহড়া শুরু করেছে, যে ব্যাপারটা কার্যত সবারই নজর এড়িয়ে গেছে। পাশাপাশি তার অস্ত্রবহর সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে মস্কো। ‘রুশ ভালুকের প্রত্যাবর্তনের’ গন্ধ পেয়ে আমেরিকার সামরিক লবি তাকে ‘যেভাবে পারো ঠেকাও’ বলা শুরু করেছে। তাদের বিশেষ আপত্তি, মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সামরিক প্রশ্নে কোনো সমঝোতা। ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদক পরিষদ এক যৌথ সম্পাদকীয়তে সাবধান করে দিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে সামরিকভাবে যেকোনো সহযোগিতা আমেরিকার জন্য বড় ধরনের ভুল হবে। কন্ডোলিৎসা রাইস ও বব গেইটস, জর্জ বুশের দুই অঘটনঘটনপটীয়সী, একই পত্রিকায় এক যৌথ প্রবন্ধে ওবামাকে বুদ্ধি দিয়েছেন, আর যা-ই করো বাপু, সিরিয়ায় রাশিয়ার সঙ্গে হাত মেলাতে যেয়ো না। যদিও ওবামা প্রশাসন ঠিক সেই কাজটি করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের সে কথায় একমত হয়ে ওবামার যুদ্ধমন্ত্রী অ্যাশ কার্টার ঘোষণা করেছেন, ওয়াশিংটন নতুন কোনো শীতল যুদ্ধ শুরু করতে চায় না, তবে সে যেকোনো মূল্যে চলতি বিশ্বব্যবস্থা রক্ষায় রাশিয়া ও চীনের হস্তক্ষেপ রুখবে। তার সে কথার ব্যাখ্যা হিসেবে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছে, ‘বিশ্বব্যবস্থা’ মানে আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য, সে ব্যবস্থা রক্ষায় আমেরিকার পরিকল্পনা কোনোভাবে বিঘ্নিত হোক, চীন বা রাশিয়াকে তেমন কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা একজন সরকারি মুখপাত্রের কথা উদ্ধৃত করে জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তারে মস্কোকে কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ছত্রখান হওয়ার পর মস্কো এত দিন মুখ্যত নিজেদের ঘর ও তার আশপাশ সামলাতেই ব্যস্ত ছিল। অক্টোবরের গোড়া থেকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আকস্মিকভাবে হস্তক্ষেপের ভেতর দিয়ে রাশিয়া তার নজর মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত করে। মুখে ‘ইসলামিক স্টেট’-এর সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করা বলা হলেও ওয়াশিংটনের চোখে সে হস্তক্ষেপের লক্ষ্য যে মস্কোর পুরোনো মিত্র বাশার আল-আসাদকে বাঁচানো, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। ওয়াশিংটনের রণকৌশলবিদেরা এ কথা বোঝানো শুরু করলেন, মস্কো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ থামাতে নয়, দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্য নিয়েই সিরিয়ায় হামলা শুরু করেছে। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় রাশিয়ার অর্থনীতির ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। এই অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে যদি দীর্ঘস্থায়ী একটা যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আজ হোক কাল হোক, তেলের দাম বাড়বেই। তা ছাড়া, যুদ্ধটা যদি ছড়িয়ে পড়ে, সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলো তাতে যুক্ত হয়, তাহলে সেখানে ভারী অস্ত্র ও বিমান বহর বিক্রির এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। এত দিন এক ওয়াশিংটন এই ফায়দা ভোগ করেছে, এখন মস্কো সেখানে বখরা চাইছে। মোটামুটি অঙ্কটা এ রকমই ছিল, কিন্তু এর মধ্যে ঘটল দুটি অঘটন। ইসলামিক স্টেট মিসরের সিনাই থেকে ওড়ার সময় একটি রুশ বিমান বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়, তাতে নিহত হয় প্রায় আড়াই শ যাত্রী, যাদের অধিকাংশই রুশ। তার পরে পরেই প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হলো ১৩০ জন, আহতের সংখ্যা প্রায় ৩০০। এই দুই ঘটনা মস্কো, পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা—ক্ষমতার এই তিন বলয়কে অভিন্ন স্বার্থসূত্রে আবদ্ধ করল।
ইউরোপের কাছে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল আইসিসকে নির্মূল করা। প্যারিস থেকে উড়ে এলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ, ওবামা ও পুতিনের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে এক নতুন ‘গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স’ গড়ার পথ পরিষ্কার হলো। এদিকে ভিয়েনায় মস্কো ও পশ্চিমা দেশগুলোর বৈঠক শেষে ঠিক হলো, আপাতত বাশারকে রেখেই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থামানোর লক্ষ্যে যুদ্ধবিরতি অর্জন করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে হাজার হাজার উদ্বাস্তু এসে পশ্চিম ইউরোপে ভিড় জমাচ্ছে, তা ঠেকাতে প্রথম কাজ হলো সিরিয়ায় যুদ্ধ থামানো। এই নতুন মেরুকরণের সরাসরি প্রভাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থামাতে একটি শান্তি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তাতে মস্কোর একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা ওয়াশিংটন মেনে নিয়েছে। এই নতুন আঁতাতের পূর্ণ সদস্য হিসেবে অংশ নিতে রাশিয়ার আগ্রহ বোঝা কঠিন নয়। আইসিস পশ্চিমের যেমন মাথাব্যথা, তেমনি মস্কোর জন্য এক মস্ত সমস্যা। যে হাজার হাজার বিদেশি সৈন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যোগ দিতে সিরিয়ায় এসে জড়ো হয়েছে, তার এক বড় অংশই এসেছে রাশিয়ার চেচনিয়া ও অন্যান্য মুসলিমপ্রধান অঞ্চল থেকে। এরা যখন নিজ নিজ শহরে-গ্রামে ফিরে যাবে, সঙ্গে থাকবে জিহাদি মন্ত্র। মস্কোকে এসব ঘরোয়া চূড়ান্তপন্থীর কথা মাথায় রাখতে হচ্ছে। অন্য কারণ, মস্কো গত এক-দেড় দশক কার্যত একঘরে হয়ে রয়েছে, ইউক্রেনে হঠকারীমূলক হামলার কারণে পুতিন ‘নতুন হিটলার’ উপাধি পেয়েছেন। মস্কো এই বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে পশ্চিমা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। আইসিস ও সিরিয়া তাকে সে সুযোগ করে দিয়েছে। এই কথার একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন, যা আমরা করতে পারি মস্কোর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিষয়ক স্টেট ইনস্টিটিউটের নামজাদা অধ্যাপক আন্দ্রা নিকমিগ্রানিয়ানের যুক্তি ধার করে। ক্রেমলিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এই রুশ অধ্যাপক ইজভেস্তিয়ায় লিখেছেন, একসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকাকে তার আদর্শগত প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবত, সে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অংশ হিসেবেই এশিয়ায় ও আফ্রিকায় এই দুই দেশ ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, আদর্শগত কারণে নিজের ‘মডেল’ চাপিয়ে দেওয়ার কোনো বাড়তি আগ্রহও তার নেই। মস্কোর জন্য অনেক বেশি জরুরি নিজের ঘর সামলানো, তার অর্থনীতি টেনে ধরা। সে লক্ষ্যেই মস্কো বাস্তবসম্মতভাবে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। কিছুটা বাঁকাভাবে হলেও সে কথাটাই লিখেছেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রুশ বিশেষজ্ঞ ইরোস্লাভ ত্রফিমফ। তিনি লক্ষ করেছেন, সোভিয়েত আমলে মস্কো নিজেকে তৃতীয় বিশ্বের ত্রাতা হিসেবে প্রমাণে ব্যস্ত ছিল। ফিলিস্তিনিদের পক্ষাবলম্বন করে সে একসময় ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখত, কিন্তু এখন এই দুই দেশের সঙ্গেই মস্কোর গভীর সখ্য। অস্ত্র বিক্রি একটা বড় লক্ষ্য, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের সঙ্গেই সে যোগাযোগ রাখতে চায়। তথাকথিত ‘আরব বসন্তের’ পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ওবামা প্রশাসন এই পরিবর্তনের পক্ষে ছিল, কিন্তু আরব বসন্তের ফলাফল তার পক্ষে যায়নি। মিসর থেকে সৌদি আরব, এই অঞ্চলের দেশগুলো দেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পুরোনো মিত্রদের ছুড়ে ফেলতে ইতস্তত করেনি। মোবারক তো আমেরিকারই সৃষ্টি, কিন্তু তাঁর বিপদের সময় ওয়াশিংটনকে সে কাছে পায়নি। এই বোধ থেকেই মিসরের নতুন শাসক জেনারেল সিসি মস্কোর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। সৌদি আরব ও একাধিক উপসাগরীয় দেশও মস্কোর সঙ্গে সামরিক চুক্তি করার উদ্যোগ নিয়েছে। একইভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে মস্কোর বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর। অন্য কথায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজস্ব গুরুত্ব নিয়ে মস্কোর প্রত্যাবর্তনের একটি বাস্তবসম্মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকা আর আগের মতো পেশিবহুল নয়, সে চাইলেও আগের মতো বোম্বেটেপনা করতে সক্ষম নয়, এই বাস্তবতা মস্কোকে উৎসাহী করেছে। কিন্তু অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ, আইসিসের বিরুদ্ধে সব পক্ষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ। কিন্তু এই সুযোগ বাস্তবায়িত হবে কি না, তার আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। অভিন্ন শত্রু সামনে রেখে সব হাত এক হলেও সে বিপদ সরে গেলে পুনরায় বিভক্তি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে বিভক্তি ও উত্তেজনা বজায় রাখার পক্ষে ওয়াশিংটন ও মস্কোতে আগ্রহী লোকের অভাব নেই, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা যত তীব্র হয়, তাতে এঁদের ততই পোয়াবারো।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.