তাঁর চলে যাওয়ার পর by মইনুল ইসলাম জাবের

কাইয়ুম চৌধুরী। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
বাবা ‘না’ বলতে পারতেন না। এ নিয়ে বিপদের অন্ত ছিল না। প্রায়ই নানা মানুষ আমাদের বাড়ির দরজায় টোকা দিতেন, টেলিফোনে রিং দিতেন আর রাস্তাঘাটে দেখা হলে পথ আগলাতেন—‘কাইয়ুম ভাই, এই কাজটি কিন্তু পরশুর মধ্যে চাই।’ কিংবা ‘আমাদের এই অনুষ্ঠানে কিন্তু আপনি প্রধান অতিথি।’ বাবা স্বভাবসুলভ হ্যাঁ বাচক উত্তর দিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত খেটে সবার মন রক্ষার চেষ্টায় প্রায় ব্যর্থ হয়ে অনেককেই শেষমেশ বলতে বাধ্য হতেন, ‘আজ নয়, কাল।’ বাবার কাছ থেকে কাজ পেতে অনেককেই তাই বেগ পেতে হয়েছে। কেউ বুঝেশুনে ‘কাইয়ুম ভাইকে’ সময় দিয়েছেন, কেউ কেউ আবার দ্বারস্থ হয়েছেন অন্য কোনো শিল্পীর। তবে যাঁরা থেকেছেন, তাঁরা বুঝেছেন কাইয়ুম চৌধুরীকে সময় দিলে কী অসাধারণ কাজ তিনি করে দিতে পারেন। আর যাঁরা এই সময়টুকু দিতে পারতেন না, পরবর্তী সময়ে তাঁরা আফসোস করেছেন কি না, জানি না।
বাবা তড়িঘড়ি কাজ করার লোক ছিলেন না। একটি কাজ তা গ্রাফিক ডিজাইন কিংবা পেইন্টিং কিংবা চারু ও কারুকলায় অন্য যেকোনো মাধ্যমেরই হোক—সে কাজে হাত দেওয়ার আগে অসংখ্য ‘লে আউট’ করা তাঁর প্রথম কাজ ছিল। এই ‘লে আউট’গুলো মূল কাজের আসল রূপ তৈরির কাজটি করত। একেকটি লে আউট মাঝে মাঝে একেকটি দিনের কাজ হতো। আর চিন্তার সাগরে ভাসতে ভাসতে এই ‘লে আউট’গুলোকে নিয়েই বাবা মূল কাজের দ্বীপটিতে তরি ভেড়াতেন। তাই সময় তো লাগতই। ছবি আঁকার প্রায় পুরোটাই যে ‘ভাববার’ বিষয়, আর কিছুটা ‘করবার’—এমন মতের শিল্পী ছিলেন বাবা। ছয় দশকের শিল্পসম্ভার আর গ্রাফিক ডিজাইনের প্রায় প্রতিটি শাখার কাজকে একবারে যদি বিশ্লেষণ করতে হয়, তবে বলতেই হবে—কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্প সৃষ্টির সম্পূর্ণটাই ছিল ভাবনার, একটি বিষয়কে বারবার নানাভাবে দেখার, বোঝার এবং তারপর দেখানোর। শিল্প সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এই দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন তিনি জীবনভর। শেষ মুহূর্তের বক্তৃতায়ও এই দর্শনেরই দিশা দিয়ে সবাইকে একসঙ্গে বিদায় দিয়ে চলে গেছেন পৃথিবীর পাট চুকিয়ে। বাবার প্রস্থান হয়েছে, তবে তাঁর দর্শনের প্রস্থান হলে এ দেশের শিল্পকলার মহা বিপদ হবে। ভাববার লোক এ দেশ থেকে বিদায় নিচ্ছেন অতি দ্রুত।
দশকওয়ারি শিল্প সাজালে বুঝতে পারা যায় কাইয়ুম চৌধুরী কীভাবে প্রায় প্রতি দশকেই নতুন করে নিজেকে, নিজের শিল্পকে এবং শিল্পদর্শনকে বদলেছেন। আমার আর বাবার শিল্পসংক্রান্ত আলোচনার প্রায় একটা বড় অংশই জুড়ে থাকত বাবার অতৃপ্তিবোধের কথা। অসম্ভব পরিবর্তনপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। সেই ষাটের দশক থেকে বাংলার রং, রূপ আর চারপাশের প্রকৃতি থেকে নানা কিছু নিয়ে তিনি যে নকশাময়ী নৌকা, সূর্য, গাছ, পশু-পাখি, নদী, মানুষের রূপ তৈরি করেছেন, তাদের প্রত্যেকেই প্রতি দশকেই বদলেছে। আর এই বদলের মধ্য দিয়েই যেন তাঁর সৃষ্টি এই মোটিফগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আমার ছোট্ট রোহিনা বলে, আকাশে আমার সূয্যি মামা আর ছবিতে দাদার সূয্যি মামা! স্টাইলাইজড যে সূর্য, যে গাছ, যে লতাগুল্ম বাবা সৃষ্টি করেছেন, এসব তো একান্ত এই বাংলার। বাবার শেষ জীবনের পেইন্টিংগুলো বাংলার লোকজ সম্ভারের দিকে এমনভাবে শিল্পালোক ছাড়াচ্ছিল, যেন তিনি চাইছিলেন বাংলার বুননশিল্পের, বাংলার নকশিকাঁথার প্রতিটি ‘সেলাই’কে ছুঁয়ে দেখবেন, তাঁর ক্যানভাসে ছেঁকে তুলবেন। ষাটের দশকের শুরু থেকেই লোকজ কলাকে আধুনিক দৃষ্টিতে দেখার যে দর্শন তিনি লালন করেছেন, শেষকালের কাজে তারই পূর্ণাঙ্গ রূপ তিনি দিয়েছেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের শিল্পকলা যদি এর গণ্ডির ভেতর থেকে বিশ্বে কিছু দিতে চায়, তবে তাকে কাইয়ুম চৌধুরীরই কাছে ফিরতে হবে।
বাবার গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে যদি কিছু বলা হয়, তবে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের গ্রাফিক ডিজাইনেরই ইতিহাস বলা হবে। তাঁর আগে কী ছিল, আর তিনি কী করেছেন—এ বয়ান অনেকগুলো বিশ্লেষণধর্মী বইয়ের উপাদান। ইলাস্ট্রেটেড প্রচ্ছদের চলকে ভেঙে প্রথমে ইলাস্ট্রেটেড ও ক্যালিগ্রাফিক প্রচ্ছদের দিকে চোখ ফেরান এবং তারপর ক্যালিগ্রাফি আর টাইপোগ্রাফির খেলায় আমাদের চোখকে নাচিয়ে তোলার কাজটি কী সন্তর্পণে তিনি করেছেন। পোস্টার চিত্রে বাবা যে অসাধারণ আধুনিকতার কাজটি করেছেন, তার রূপ খুঁজতে কষ্ট করার প্রয়োজন হবে না—‘এশিয়ান বিয়েনাল’-এর পোস্টারগুলো দেখলেই তা বোঝা যাবে। যখন যেমন দরকার, তখন তেমনভাবে টাইপ, রং, ছবি কিংবা অলংকরণের মধ্য দিয়ে ‘কমিউনিকেটিভ’ পোস্টারে বাংলাদেশের গ্রাফিক ডিজাইনকে মাতিয়েছেন তিনি। এরপর লোগো কিংবা পত্রিকার নামলিপি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ম্যাগাজিন এবং দৈনিকের ‘মেকআপ’ পর্যন্ত করেছেন বাবা। প্রতিটি কাজে তিনি নিজেই ছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। বারবার বদলে নিয়েছেন অতীতের করা কাজ। ছোট একটা উদাহরণ দিই, প্রথম আলোর সহযোগী ‘প্রতিচিন্তা’ জার্নালটির প্রতিটি সংখ্যার নামফলকের প্রতিবর্তন ঘটিয়ে প্রচ্ছদ করেছেন বাবা। হাতে নিয়ে দেখলে অবাক হতে হয়, মাত্র চারটি অক্ষরকেই কী করে একজন মানুষ এতভাবে দেখতে পারেন? দেখাতে পারেন? আমাদের শহীদ মিনারটিকে প্রচ্ছদে, পোস্টারে, ক্যানভাসে বাবা এমনই অসংখ্যবার অসংখ্যভাবে দেখিয়েছেন। দেখার চোখ তাঁর ছিল, দেখানোর হাতটাও ছিল অসাধারণ। তবে দেখার লোকেরা তা কেমন দেখেছে, তা বলা দুষ্কর।
বাংলাদেশের শিল্পজগতে বাবার এত যে বিস্তর অবদান, এ সবকিছুই কিন্তু হয়েছে তাঁর সেই অকৃত্রিম ‘না’ বলতে না পারার কারণেই। নানা মানুষের নানা কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে তিনি শিখেছেন, পরোক্ষভাবে সবাইকে শেখাতে চেয়েছেন। জোর করে পড়িয়ে শেখানোর মানুষ তিনি ছিলেন না। কাজ করে যেতেন। বুদ্ধিমানেরা সেখান থেকেই শিখে নেবে—সেটাই ভাবতেন। এ দেশে এমন শিল্পীকে কেবল শিল্পের মাঝেই আবদ্ধ থাকলে তো চলে না; নানা সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক কাজেও জড়াতে হয়। বাবাও তেমনভাবে জড়িয়েছিলেন। কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায়। সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে শিল্পীসমাজের একজন নেতা কাইয়ুম চৌধুরী হলেও সাংগঠনিক কাজের ঘোরপ্যাঁচ বোঝার মানুষ তিনি ছিলেন না। শেষ জীবনে সে জন্য বেশ মানসিক কষ্টে ভুগতে হয়েছে তাঁকে। তবু দেশকে এবং মানুষকে ভালোবাসার যে দর্শন তিনি লালন করেছিলেন, সেই তরুণ জীবনে তা থেকে একচুলও নড়েননি। শেষকালের বক্তৃতায় এই ভালোবাসার কথা আশাভরা বুকে বলে গেছেন তিনি।
লেখাটির শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছি। বাবা যে নেই, সেটি এখনো মানতে পারি, তা নয়। নিজের কর্মক্ষেত্রে দেশে কিংবা বিদেশে যত কিছুই করি, শেষমেশ মানুষ আমার বাবার জন্যই আমাকে ভালোবাসে। কিছুদিন আগে ইউরোপের এক দেশে কিছু বিজ্ঞানীর মাঝে যখন একজন পরিচিত আমার বাবার কথা ওঠালেন, তখন সবার দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখেছি; শিল্প ও শিল্পীকে ওরা কতটা মর্যাদা দিতে শিখেছে। বাংলাদেশে তার রেশমাত্র যদি দেখতে পেতাম, তবে বেশ ভালোই লাগত। এখানে শিল্পীর সামাজিক মর্যাদা হয়তো আছে। তবে শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা এখনো নেই। শিল্পের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যই জনে জনে ‘শৈল্পিক চোখ’ খুলে দেওয়ার লক্ষ্যেই আমার বাবা তাঁর ‘শেষ মুহূর্ত’ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন। জনমানুষের বিশাল আড্ডায় শিল্পীকে নয়, বরং শিল্পকে বাঁচানোর আহ্বান জানিয়েই চিরবিদায় নিয়েছেন কাইয়ুম চৌধুরী। আজ ৩০ নভেম্বর, বাবার চলে যাওয়ার একটি বছর পর এই রইল কামনা—এ দেশ যেন তাঁর শিল্পকলাকে ভালোবাসতে শেখে।
মইনুল ইসলাম জাবের: প্রয়াত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ছেলে।

No comments

Powered by Blogger.