সংঘর্ষ-গুলি অবরুদ্ধ মেয়র

তেজগাঁওয়ে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদে গিয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ সময় পার করে বিকালে এলাকা ত্যাগ করেন তিনি। অভিযানের শুরুতে পুলিশের সঙ্গে ট্রাকশ্রমিকদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া একপর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নেয়। শ্রমিকরা অভিযান পরিচালনাকারীদের ওপর ইটপাটকেল ছুড়ে চড়াও হয়। এ সময় পুলিশ পালটা ছররা গুলি ছুড়ে বলে অভিযোগ করেন শ্রমিকরা। এতে অন্তত তিনজন আহত হন। এরপর শ্রমিকরা পুরো এলাকায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তারা মেয়রের প্রটোকলে থাকা একটি গাড়িও ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় উচ্ছেদ অভিযান। বেলা দেড়টা থেকে বিকাল ৪টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের অফিসে আটকে থাকতে হয়। বিকালে উপস্থিত শ্রমিকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন মেয়র। তিনি একটি উন্নত ট্রাক টার্মিনাল স্থাপনের আশ্বাস দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রহরায় এলাকা ত্যাগ করেন। পরে সন্ধ্যার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। গত মে মাসে দায়িত্ব নেয়ার পরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে গতকালই বড় অভিযানে নামেন আনিসুল হক। তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকা থেকে কাওরান বাজার  রেলক্রসিং পর্যন্ত টার্মিনালের বাইরে অবৈধভাবে ফেলে রাখা পুরনো ট্রাক ও বিভিন্ন স্থাপনা সরাতে বেশ কিছুদিন ধরেই সতর্ক করে আসছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। গত ৮ই নভেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত পাঠিয়ে অভিযান চালানোর পর অবশিষ্ট স্থাপনা সরাতে ২৭শে নভেম্বর পর্যন্ত সময় দেন তিনি। ওই সময়  পেরিয়ে যাওয়ায় রেলমন্ত্রী মুজিবুল হককে সঙ্গে নিয়ে বেলা ১টার দিকে সাতরাস্তা এলাকায় যান আনিসুল হক। র‌্যাব ও পুলিশের প্রহরার মধ্যে সিটি করপোরেশনের বুলডোজার অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করে। ট্রাক শ্রমিকরা বেলা দেড়টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে ঢিল ছুড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। অল্প সময়ের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে মেয়র আনিসুল হক ও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ড্রাইভার্স ইউনিয়নের কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন। কিছুক্ষণ পর রেলমন্ত্রী চলে গেলেও মেয়র সেখানেই অবস্থান করেন। যদিও আগের দিন সিটি করপোরেশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়ে ছিল অভিযানে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল উপস্থিত থাকবেন। তবে অভিযান শুরুর সময় এ দুই মন্ত্রী ছিলেন না।
এদিকে শ্রমিকদের রোষে পড়লেও মেয়র দৃঢ়ভাবে বলেন, কয়েকজন মানুষের স্লোগানে ভয় পেয়ে যাবো- এমন ভাবার কিছু নেই। নগরবাসী যাতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারেন সেই কাজ করছি। কেউ উত্তেজিত করলেন আর আমি আমার লোক নিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলাম; না এটা হবে না। এদিকে জসিম উদ্দিন নামে এক শ্রমিক মারা গেছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকরা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারা রাস্তায় কভার্ডভ্যান দাঁড় করিয়ে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে। বাইরে শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলার মাঝেই পাশের একটি মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা আসে- ‘মেয়র শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়েছেন। মাইকের ঘোষণায় বলা হয়, পুলিশের গুলিতে আহত শ্রমিকের চিকিৎসার ভার নেবেন মেয়র। পাশাপাশি বিকল্প ট্রাকস্ট্যান্ড না হওয়ার আগে বর্তমান স্ট্যান্ড থেকে ট্রাক সরাতে চাপও দেয়া হবে না। এই ঘোষণার পর শ্রমিকরা অনেকটা শান্ত হয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর চালক সমিতির কার্যালয় থেকে  বেরিয়ে এসে হ্যান্ডমাইকে শ্রমিকদের উদ্দেশে কথা বলতে শুরু করেন মেয়র। তিনি বলেন, নিজের জন্য তিনি এই ট্রাকস্ট্যান্ড সরানোর কাজ করছেন না। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে জনগণের চলাফেরা নির্বিঘ্ন করতে। এ বিষয়ে তিনি ভোটার ও সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মেয়রের বক্তব্য চলাকালে শ্রমিকদের মধ্যে আবারও উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আনিসুল হক বার বার বলেন- ‘আমার কথা শুনুন, আমার কথা শুনতে হবে’। এই এলাকায় আজ যে সমস্যা সেটা ছোট্ট একটা সমস্যা। রাস্তায় ট্রাক পার্কিং না করে ভেতরে টার্মিনাল বানাব আমরা। চারজন মন্ত্রী আমার এই উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন। রাস্তাটা ভালোভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছিল না। দুইমাস ধরে আমি এটা নিয়ে কথা বলছি। মলিকপক্ষ আমাকে বলেছে টার্মিনালের ভেতরের অংশটা যাতে তাদের পরিষ্কার করে দেয়া হয়। সেজন্যই ভেতরের নষ্ট অকেজো ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন সরানো হচ্ছে।
যারা এই জায়গা অবৈধভাবে দখল করে আছেন, আপনাদের সবার সুবিধার জন্য টার্মিনালের ভেতরে বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকা গাড়িগুলো সরানো হচ্ছে, আমার সুবিধার জন্য নয়। বক্তব্য শেষ করার আগে মেয়র বলেন, তাহলে আমরা ঠিক করলাম এই জায়গায় যেসব গাড়ি আছে এগুলো ভেতরে থাকবে। আপনাদের আমরা একটা ভালো ট্রাক স্ট্যান্ড উপহার দেবো। বেলা পৌনে ৫টার দিকে র‌্যাব ও পুলিশ বেষ্টিত হয়ে গাড়িতে ওঠে ফার্মগেইটের দিকে চলে যান মেয়র। পরে রাস্তা আটকে থাকা শ্রমিকদেরও পুলিশ সরিয়ে দেয়। সংঘর্ষের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে তিন প্লাটুন পুলিশ, রায়টকার, জলকামান ও র‌্যাব’র সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতির কারণে শ্রমিকরা রাস্তা ছেড়ে দেন। এদিকে সংঘর্ষের সময় আহত জসিম উদ্দীন (৪০), মো. বদরুদ্দোজা (৫৫) ও মাসুম বিল্লাহ (২৫)কে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
বাংলাদেশ ট্রাক ও কার্ভাড ভ্যান ড্রাইভার ইউনিয়নের সদস্য ট্রাক চালক সাগর হোসেন জানান, ১৫ দিন আগে মেয়র আনিসুল হক আমাদের অফিসে আসেন। তিনি বাংলাদেশ ট্রাক মালিক সমিতি ও ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে মিটিং করেন। তিনি আরও জানান, ওই মিটিং তেজগাঁও টার্মিনালের আশপাশের সকল অবৈধ স্থাপনার উচ্ছেদের করা হবে বলে তিনি জানান। প্রতিশ্রুতি দেন, অফিসের পেছনের রেলের সম্পত্তি ৩৯ একর জমিতে তিনি আধুনিক একটি ট্রাক টার্মিনাল করে দিবেন।
আরেক সদস্য মানিক নিয়াজী দাবি করে জানান,  ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে টার্মিনালে কোন স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়নি। ওই বৈঠকে ইউনিয়নের নেতারা মেয়রকে জানিয়েছিলেন যে, একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে তারা বৈঠক করে বিষয়টি জানাবেন। কিন্তু, তিনি তাদের সিদ্ধান্ত না মেনে সকাল বেলায় স্থাপনা উচ্ছেদ করতে এলে মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
পুলিশের তেজগাঁও জোনের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার জানান, পুলিশ ও শ্রমিকের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিতে ওই ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ কোন গুলি ছুড়েনি। ইটের আঘাতে তিনজন আহত হয়েছেন। মেয়রের আশ্বাসের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। শ্রমিকরা একপর্যায়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও ধৈর্যের পরিচয় দেয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.