বিদ্যার জন্য শুভকামনা by মহিউদ্দিন আহমদ

নেপালের নতুন প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি
তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ২০০১ সালে, কাঠমান্ডুতে। আমি তখন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নাগরিক সমাজের নেটওয়ার্ক ‘পিপলস প্ল্যান ফর টোয়েন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরি’র মূল্যায়নের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এ উপলক্ষে নেটওয়ার্কের সদস্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য আমাকে কাঠমান্ডু, দিল্লি, কলকাতা ও ব্যাংকক আসা-যাওয়া করতে হয়েছিল। তো কাঠমান্ডুতে একটা মতবিনিময় সভা করলাম। ওখানে অনেকের মধ্যে অংশ নিয়েছিলেন ‘অল নেপাল ওমেন’স অ্যাসোসিয়েশনের’ সভানেত্রী। এটা ‘ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল-মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট’-এর সহযোগী গণসংগঠন। এই পার্টিকে সংক্ষেপে সবাই বলেন ‘ইউএমএল’। দলটি এখন নেপালের ক্ষমতাসীন জোটের বড় শরিক। এই দল থেকেই সম্প্রতি দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন আর কেউ নয়, অল নেপালি ওমেন’স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভানেত্রী, যাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ২০০১ সালে। তিনি বিদ্যা দেবী ভান্ডারি। আমরা তাঁকে বিদ্যা বলেই জানি।
বিদ্যার স্বামী মদন ভান্ডারি একসময় নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন দলটি ছিল আরও বড়। মদন ছিলেন দলটির কান্ডারি। ১৯৯৬ সালে নগরকোট যাওয়ার পথে তাঁকে বহনকারী গাড়িটি উঁচু পাহাড়ি পথ থেকে খাদে পড়ে গেলে তিনি নিহত হন। এর তিন বছর পর দলের একটা অংশ নিয়ে কয়েকজন ভিন্নমতাবলম্বী নেতা বেরিয়ে যান। পরে তঁারা তৈরি করেন ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল-মাওয়িস্ট’। এর প্রধান নেতা হলেন পুষ্প কমল দহল। প্রচণ্ড নামে তাঁকে সবাই চেনেন।
স্বামী দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর বিদ্যা দলের মধ্যে ধীরে ধীরে জায়গা করে নেন। তাঁর দল ১৯৯৪ সালে একটি কোয়ালিশন সরকারেরও নেতৃত্ব দিয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দলের নেতা মনমোহন অধিকারী। এই অঞ্চলে এটাই ছিল কমিউনিস্ট পরিচালিত প্রথম নির্বাচিত সরকার। ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে বিদ্যা পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক সমাজের একটা নেটওয়ার্ক হলো সাউথ এশিয়া ‘অ্যালায়েন্স ফর পভার্টি ইরাভিকেশন’, সংক্ষেপে ‘সাপে’। বিদ্যা এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে প্রথম থেকেই ছিলেন। আমরা দুজনই এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ২০০১ সাল থেকে। তারপর তাঁর সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে, কাঠমান্ডু, ইসলামাবাদ কিংবা কলম্বো শহরে। ইসলামাবাদের একটা ঘটনা ভোলার নয়।
২০০৪ সালের জানুয়ারিতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হলো। আমরা ‘সাপে’র পক্ষ থেকে আয়োজন করলাম সমান্তরাল সম্মেলন ‘পিপলস সার্ক’। সভা শেষে আমরা ফিরে আসছি যার যার দেশে। ইসলামাবাদ বিমানবন্দরের বহির্গমন লাউঞ্জে বসে আছি। বিদ্যাও আছেন সেখানে। আমার সহযাত্রীদের অন্যতম ছিলেন সাংবাদিক সোহরাব হাসান। আমরা দুবাই হয়ে ঢাকা ফিরব। কিন্তু বিমান ছাড়ার ঘোষণা দিচ্ছে না। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, এক ঘণ্টা-দুই ঘণ্টা। আমরা খুবই বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। শুনলাম একজন ভিভিআইপি যাবেন। তাই সব ফ্লাইট বন্ধ হয়ে আছে। আগে ওই অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিমান উড়বে। তারপর আমাদেরটা। জানালার কাচ ভেদ করে চোখ পড়ল টারমাকের ওপর। দেখি লালগালিচা বিছানো। তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুম।
মামুন আবদুল গাইয়ুমের জন্য পুরো বিমানবন্দর দুই ঘণ্টা অচল! কিন্তু এটা হলো তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলোর ‘নিরাপত্তা প্রটোকল’। এখন বিদ্যা ভান্ডারি নেপালের রাষ্ট্রপ্রধান। তিনিও একই ধরনের প্রটোকল পাবেন। তবে আমি তাঁর জন্য দুই-তিন ঘণ্টা হাসিমুখেই অপেক্ষা করতে রাজি আছি। কারণ, তিনি আমাদের বন্ধু, আমাদেরই একজন।
মাঝে বিদ্যা খুব অসুস্থ ছিলেন। ক্যানসারে ভুগেছিলেন বেশ কয়েকটা বছর। এটা ছিল তাঁর এক প্রাণপণ লড়াই, অসুখকে জয় করার। অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি অল্প কিছুক্ষণের জন্য আমাদের একটা সভায় এসেছিলেন। এটা ২০০৭ কিংবা ০৮ সালের কথা। যা হোক, লড়াই করে তিনি কর্কট রোগকে বশে রেখেছেন এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজনীতিতেও বহাল থেকেছেন প্রবল প্রতাপে। এর আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রীও হয়েছিলেন।
এই অঞ্চলে বেশ কয়েকজন কমিউনিস্ট নেতা-নেত্রী দেখেছি। নেপালের মানুষ এমনিতেই অমায়িক। ওদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো এখনো জনগণের দল, শুধু একজন নেতার প্যাড-সর্বস্ব দল নয়। এর মধ্যেই বিদ্যা তাঁর দলের শীর্ষে পৌঁছাতে পেরেছেন, পেয়েছেন জনগণের ভালোবাসা। এখন তো তিনি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। বিদ্যা ভান্ডারি, আপনার জন্য শুভকামনা রইল।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক-গবেষক
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.