প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা: ইউরোপের ভেতরের যুদ্ধ? by মশিউল আলম

শুক্রবার সন্ধ্যার পরে প্যারিসে ফ্রান্সের জাতীয় স্টেডিয়ামে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ চলছিল ফরাসি ও জার্মান জাতীয় ফুটবল দলের মধ্যে। দর্শকদের সারিতে পাশাপাশি বসে খেলা উপভোগ করছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ও জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমাইয়ার। হঠাৎ বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে হতচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। তাঁর দেহরক্ষী দল ছুটে এসে তাঁকে তড়িঘড়ি সেখান থেকে বের করে নিয়ে চলে গেল।
এর কিছু সময় পরে প্রেসিডেন্ট ওলাঁদকে দেখা গেল টেলিভিশনের পর্দায়। জাতির উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘যে মুহূর্তে আমি আপনাদের উদ্দেশে কথা বলছি, তখন অভূতপূর্ব মাত্রার একাধিক সন্ত্রাসী হামলা চলছে প্যারিসের বিভিন্ন জায়গায়।...কয়েক ডজন লোক নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে অনেকে। এটা একটা বিভীষিকা।’
ওই রাতে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে প্যারিস নগরের ছয়টি জায়গায়; নিহত হয়েছে অন্তত ১২৭ জন। আহত হয়েছে প্রায় ২০০ জন, তাদের মধ্যে অন্তত ৮০ জনের অবস্থা গুরুতর। প্যারিসের পুলিশ কর্তৃপক্ষের বরাতে কিছু কম-বেশি এ রকম তথ্যই জানা গেল বার্তা সংস্থা এএফপি, যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক নিউইর্য়ক টাইমস, যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান, দ্য ইনডিপেনডেন্ট, রুশ দৈনিক ইজভেস্তিয়ার অনলাইন সংস্করণসহ বিভিন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যম থেকে।
শনিবার বিকেলে ইসলামি স্টেট (আইএস) হামলাগুলোর দায়িত্ব স্বীকার করার আগেই নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, হামলার পরপরই মাইক্রোব্লগের জনপ্রিয় সাইট টুইটারে ইসলামিক স্টেটের সমর্থকদের অ্যাকাউন্টগুলো উল্লাসে ভরে গেছে। পত্রিকাটি আরও লিখেছে, প্যারিসের বাতাক্লোঁ কনসার্ট হলে কনসার্ট চলার সময় সন্ত্রাসী হামলার সময় এক প্রত্যক্ষদর্শী ফ্রান্সের বিএফএম টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, তিনি একজন হামলাকারীকে গুলি করতে করতে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করতে দেখেছেন। রুশ দৈনিক ইজভেস্তিয়া লিখেছে, ইতালির লা রিপুবলিকা পত্রিকা বাতাক্লোঁর প্রবেশপথে একটা সাইনবোর্ডের ছবি প্রকাশ করেছে, যেখানে শার্লি এবদো পত্রিকার অফিসে আল-কায়েদা জঙ্গিদের হামলায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে লেখা রয়েছে Je Suis Charlie (আমি শার্লি এবদো)। স্মরণ করা যেতে পারে, মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করার পর শার্লি এবদোর অফিসে হামলা চালিয়ে ইসলামি জঙ্গিরা ১৭ জন সাংবাদিককে হত্যা করেছিল।
অবশ্য প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ শুক্রবার রাতে তাঁর টিভি ভাষণে কোনো গ্রুপের নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘আমরা জানি, এসব হামলা কারা চালাচ্ছে।’ তাঁর ইঙ্গিতও ছিল ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের প্রতিই। পরে তিনি সেটা স্পষ্ট করেই বলেছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবল স্পষ্ট করে বলেন, ‘এই হামলগুলোতে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতার সব লক্ষণ আছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বা ন্যাটোর মহাসচিব—কেউই আইএসএর নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু আইএস দায় স্বীকার করার আগে থেকেই ‘টেরোরিস্ট’, ‘ডেভিল’ এবং বাকি যেসব তীব্র নেতিবাচক বিশেষণের সঙ্গে হামলাকারীদের নিন্দা জানানো হচ্ছিল, ‘সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে ‘গণতন্ত্রের’ বিজয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছিল, তাতে এটা বুঝতে মোটেও কষ্ট হচ্ছিল না যে গোড়া থেকেই সবার আঙুল ছিল ইসলামি জঙ্গিবাদীদের দিকেই।
কিন্তু প্যারিস হামলার দায় স্বীকারকারী এই ‘আইএস’ও আমাদের দেশের ‘আইএস’ বা ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর মতো ভারচুয়াল কি না, কে জানে। এক বন্ধু টেলিফোনে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, প্যারিস, ঢাকা, রংপুরের কাউনিয়া, ঈশ্বরদী একই সূত্রে গাঁথা কি না। এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। কারণ এ ব্যাপারে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। অবশ্য জল্পনা-কল্পনা ও ‘ষড়যন্ত্র’ আছে অনেক। আমাদের সরকার বলছে, পশ্চিমা শক্তিগুলো আমাদের দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিতে চায় যে এ দেশে আইএস আছে। তাহলে তাদের এ দেশের ওপর ‘হামলে পড়তে’ সুবিধা হবে।
কিন্তু প্যারিসে শুক্রবারের হত্যাযজ্ঞগুলোর ফলে কার কী সুবিধা হবে? এসব হামলা যদি সত্যিই আইএসের কাজ হয়ে থাকে, তাহলে খোদ ইউরোপীয় ভূখণ্ডের ভেতরে একের পর এক এগুলো তারা চালাতে পারছে কীভাবে? একই সঙ্গে এই প্রশ্নও চলে আসে, আইএস বা আইসিস বা দায়েশ আসলে কী? তাদের এমন ধ্বংসক্ষমতার উৎস কোথায়?
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের একটা অংশ অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখানোর চেষ্টা করেছে, আইসিস আমেরিকা ও তার মিত্রদের তৈরি করা এক ভয়াবহ সশস্ত্র গোষ্ঠী, যাদের ব্যবহার করে বৈশ্বিক রাজনীতির একটা বড় অংশের কলকাঠি নাড়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত ও কাতারের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অর্থ, অস্ত্র ও পরামর্শ দিয়ে আইএসকে পরিপুষ্ট করেছে, এমন বক্তব্য–বিশ্লেষণসহ প্রচুর লেখা ইন্টারনেটে খুঁজলে পাওয়া যায়। এমন বক্তব্যও পাওয়া যায় যে আইএস আমেরিকা ও তার মিত্রদের জন্য এখন একটা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ, এই ভয়াবহ দানব এখন আর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই।
এ রকম ধারণা কিছুটা সত্য হতেও পারে। এবং এমন সংশয়ও পুরোপুরি অমূলক হবে না, ইসলাম ধর্মের ঝান্ডাধারী সশস্ত্র কিছু গোষ্ঠীকে সম্ভবত ইউরোপীয় ভূখণ্ডের ভেতরের শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী ব্যবহার করছে। এই গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতা পেতে চায়, নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায়। সেই লক্ষ্য হাসিলের উপায় একটাই, নির্বাচনে জয়ী হওয়া। কিন্তু আধুনিক ইউরোপে বহুত্বকামী মানুষ এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ; পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসী নাগরিকদের সমান নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ব্যাপারে তাদের আপত্তি নেই। এই বহুত্ববাদী, উদার গণতান্ত্রিক ইউরোপের বিপরীতে বিশুদ্ধ জাতীয়তাবাদী ইউরোপের স্বপ্নে উজ্জীবিত গোষ্ঠীগুলো পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সব দেশেই ক্রমশ আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আইএস কি এখন তাদের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? এ রকম একটার পর একটা হামলার মধ্য দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো কি উদারপন্থী ইউরোপীয়দের মনে মুসলিম-বিদ্বেষ, অভিবাসী-বিদ্বেষ, বর্ণবাদী-বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে?
প্যারিসে শুক্রবারের হামলাগুলো যারা চালিয়েছে, এ পর্যন্ত জানা খবরে তাদের মোট সংখ্যা ছিল আট। সাতজনই নির্বিচার গুলিতে সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর একপর্যায়ে নিজেদের বুকে ও কোমরে বাঁধা আত্মঘাতী বোমা ফাটিয়ে মারা গেছে। অবশিষ্ট একজন মারা গেছে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। এটা একটা কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়: হামলাকারীরা শেতাঙ্গ না ভিন্ন বর্ণের? ফ্রান্সের নাগরিক, নাকি বিদেশ থেকে আসা? ফ্রান্সের নাগরিক হলে ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত, নাকি পাকিস্তান-আফগানিস্তান-বাংলাদেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের অভিবাসীদের সন্তান? সবাই মুসলমান কি না? এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা গেল, একজন হামলাকারীকে তাঁর মনে হয়েছে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘কমব্যাট সোলজার’।
ফরাসি পুলিশ সম্ভবত নিহত সব হামলাকারীর পরিচয় আদ্যোপান্ত উদ্ধার করে ফেলবে। আমরা তা জানতে পারব কি না, তা অবশ্য বলা যায় না। এ ধরনের হামলায় কখনো কেন একজন হামলাকারীকেও জীবন্ত ধরা সম্ভব হয় না, এমন প্রশ্নও আছে।
যাই হোক, আমাদের মনে যত প্রশ্ন জাগে, উত্তর জানার ততো উপায় আমাদের নেই। আমরা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের ওপর নিরুপায়রূপে নির্ভরশীল এবং নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা ও ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ আমাদের ভাবনাগুলো এলোমেলো করে দিতে পারে।
পশ্চিমাদের দেওয়া আরও কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরা যাক: গার্ডিয়ান লিখেছে, এ বছরের এপ্রিল মাসে ফ্রান্সের সিনেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের প্রকাশ করা হিসাব অনুযায়ী ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে তিন হাজারের বেশি ‘জিহাদি’ তরুণ-তরুণী সিরিয়া ও ইরাকে গিয়ে ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৪৩০ জনই ফরাসি নাগরিক। এ বছরের আরও আগের দিকে বার্তা সংস্থা এএফপি লিখেছিল, ফ্রান্সে বসবাসরত ১ হাজার ৫৭০ জন ফরাসি নাগরিক সিরিয়ার জিহাদিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানতে পেরেছে। তারা আরও ধারণা করছে, প্রায় সাত হাজার ফরাসি নাগরিক আইএসের সঙ্গে যোগ দিতে সিরিয়া-ইরাকে যেতে পারেন। ফরাসি পুলিশ কর্তৃপক্ষের হিসাবে, বর্তমানে দেশটিতে ১৫০ জন ফরাসি নাগরিক ‘জিহাদি’ কর্মকাণ্ডের অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাভোগ করছেন এবং আরও ২০০ জন মুক্তভাবে চলাফেরা করছেন, যাঁরা সিরিয়া ও ইরাকের আইএস-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো থেকে ঘুরে এসেছেন।
এসব তথ্যের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওলাঁদের ‘আমরা জানি, এসব হামলা কারা চালাচ্ছে’ উক্তিটা যোগ করলে প্রতীয়মান হয়, আইএস সম্ভবত এখন ফ্রান্সের ভেতরেরও বাস্তবতা। আরেকটু বড় অর্থে, এটা ইউরোপের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ।
আধুনিক, বহুত্ববাদী, উদার গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী ইউরোপ এই যুদ্ধ কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.