বাংলাদেশেও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রার্থনা by সোহরাব হাসান

একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষমতা যে কত অপরিসীম, জনগণের রায়ের শক্তি যে কত অপ্রতিরোধ্য, বাংলাদেশের চেয়ে বেশি কোনো দেশ জানে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ জনগণের রায় তথা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আর আমরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। সত্তরের সেই নির্বাচনে যদি আমরা এত বিপুল ভোটে বিজয়ী না হতাম, বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের স্বাধীনতার দাবির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম না। সেই নির্বাচনের রায় বানচাল করতে যদি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষের ওপর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ না চালাত, যদি সেই নির্বাচনের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করত, তাহলে হয়তো ইতিহাস ভিন্ন হতো।
জনগণের এবং জনরায়ের শক্তি যে কামান-বন্দুক দিয়ে দমন করা যায় না, একাত্তরে এ দেশের মানুষ তা প্রমাণ করেছে। গণতন্ত্রের জন্য যে লড়াই, সেটি স্বাধীনতার পরপরই শেষ হয়ে যায়নি। নির্বাচন ও শাসনপদ্ধতি নিয়ে আমরা কদাচিৎ একমত হতে পেরেছি। আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক।’ নেতা-নেত্রীরাও বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রায়ই বাক্যটি আওড়ান। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় সেই জনগণকে তঁারা সম্পৃক্ত করতে চান না। বরং জনগণের শক্তিকে ভয় পান বা এড়িয়ে চলেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যাঁরা সাচ্চা গণতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তঁাদেরই দেখা গেছে সেনাশাসকদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে।
গণতন্ত্র নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই দেশে যে সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর চেপে বসে, কেউ কেউ তাকে ‘সিপাহি জনতার বিপ্লব’ বলে যতই গৌরবান্বিত করুন না কেন, সত্তরের শেষার্ধ ও আশির দশকজুড়ে দেশে সামরিক শাসনবিরোধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তারও প্রধান লক্ষ্য ছিল একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক এরশাদ বিতাড়িত হওয়ার পর ১৯৯১ সালে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয় একটি গণতান্ত্রিক সরকার ও সংসদ। সেই সংসদেই প্রথম ও শেষবারের জন্য সরকার ও বিরোধী দল মিলে সংসদীয় গণতন্ত্রে পুনঃপ্রবর্তন করে, যা ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনের মাধ্যমে হরণ করা হয়েছিল। এরপরও নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে দেশে যে তিনটি নির্বাচন হয় (১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর), তা মোটামুটি অবাধ সুষ্ঠু বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।
কিন্তু পরাজিত দল যেমন সেই নির্বাচন হৃষ্টচিত্তে মেনে নেয়নি, তেমনি বিজয়ী দলও দেশ পরিচালনায় বিরোধী দলকে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সরকারি দল, বিরোধী দল নির্বাচন কমিশন—এই তিন পক্ষের কেউই খেলার নিয়ম মানেনি বলেই দেশবাসী তাদের পছন্দসই প্রতিনিধি বেছে নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে আমরা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কাছের ও দূরের চারটি দেশের নির্বাচনী ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতে পারি। এই চারটি দেশের মধ্যে যেমন দীর্ঘ সামরিক শাসনকবলিত মিয়ানমার আছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক সংঘাতের শিকার তুরস্কও। অন্য দুটি দেশ হলো ভারত ও কানাডা। এর মধ্যে একমাত্র তুরস্ক ছাড়া বাকি তিনটিতেই বিরোধী দল বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে। গত জুনে তুরস্কে প্রথম ধাপের ভোটে ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ৪০ শতাংশ ভোট পেলেও মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে ৪৮ শতাংশে উন্নীত করে ৬৩০ সদস্যের পার্লামেন্টে ৩১৬টি পেয়ে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়েছে। নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে আঙ্কারা রেলস্টেশনের কাছে দুটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় শ খানেক মানুষ নিহত হয়। জঙ্গি সংগঠন আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করে। মধ্যপন্থী বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি জনজীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি নির্বাচনে ইস্যু করেও সুবিধা করতে পারেনি।
কানাডার ফলাফল পুরোপুরি বিপরীতমুখী। ২০১১ সালে লিবারেল পার্টি যেখানে ৩৪টি আসন পেয়েছিল, সেখানে এবার ৩৩৮ আসনের পার্লামেন্টে ১৮৪টি আসন পেয়েছে। কীভাবে এই অসম্ভব ঘটনা ঘটল? ক্ষমতায় থাকতে যেসব ভুল তারা করেছিল, সেগুলো ভবিষ্যতে করবে না বলে জনগণকে আশ্বস্ত করেছে এবং দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন এনেছে। অন্যদিকে, ২০১১ সালে যে প্রত্যাশা নিয়ে জনগণ তার প্রতিপক্ষকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল, তারা সেটি পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনেরা কখনো ভুল করে না। আর বিরোধীরাও নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর আত্মসমালোচনা কিংবা নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার কথা ভাবে না।
ভারতের বিহারের নির্বাচন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় দলের জন্যই একটি উদাহরণ হতে পারে। মাত্র দেড় বছর আগে ২০১৪ সালের মে মাসে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি গত ৫০ বছরের মধ্যে রেকর্ড-সংখ্যক আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনের আগে বিজেপি মেড ইন ইন্ডিয়ার গালভরা বুলি আওড়ালেও নির্বাচনের পর ধর্মীয় উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দুত্ববাদকেই উসকে দিয়েছে। উগ্রপন্থীদের হাতে একজন লেখক খুন হন, দাদরিতে গরুর মাংস খাওয়ার মিথ্যা অপবাদ দিয়ে একজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যার পর দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় বইলেও ক্ষমতাসীনেরা আমলে নেননি। বরং বিহারের নির্বাচনেও তারা সেই সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গেলে মানুষ তা পছন্দ করেননি। তারা নিতীশ কুমার-লাল্লু প্রসাদের বিজেপিবিরোধী মহাজোটকেই ফের ক্ষমতায় নিয়ে আসে। অথচ বছর দুই আগেও বিহারে বিজেপি ছিল নিতীশ কুমারের সরকারের অন্যতম শরিক। এর আগে দিল্লির রাজ্য নির্বাচনেও বিজেপি কেজরিওয়ালের আম আদমির কাছে গো হারা হারে; যদিও ভারতের কেন্দ্রে এবং অনেকগুলো রাজ্যও মোদির দলই ক্ষমতায়।
আর আমাদের পুবের পাশের দেশটিতে যে অভাবিত ঘটনা ঘটেছে, তা কেবল মিয়ানমারের নির্বাচনের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব নির্বাচনের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেখানে জনগণ তাদের পছন্দসই দল ও প্রার্থীকে বেছে নিতে পেরেছে। গণতন্ত্রের এই শুভসূচনার জন্য যেমন দেশটির জনগণ কৃতিত্ব দাবি করতে পারে, তেমনি ধন্যবাদ পেতে পারেন ক্ষমতাসীন সেনা-বেসামরিক যৌথ নেতৃত্বও।
ছাত্র, গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ১৯৮৮ সালে নে উইন সরকারের পতন ঘটলেও পরবর্তী আড়াই দশক নানা নামে সেনাবাহিনীই দেশটি শাসন করে আসছে। নব্বইয়ের নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) জয়ী হলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তারা দমন–পীড়ন চালাতে থাকে এবং গণতন্ত্রের নেত্রী বলে খ্যাত অং সান সু চিকে অন্তরীণ রাখে। তখন পর্যন্ত মিয়ানমার ছিল বহির্বিশ্ব থেকে প্রায় ‘বিচ্ছিন্ন’। অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকলে সামরিক জান্তা তাদের সঙ্গে আপসরফায় আসে। ২০০৮ সালে জেনারেল থেইন সেইন ক্ষমতায় এসে ‘সীমিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যাতে সেনাবাহিনীর জন্য পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। এ ছাড়া সংবিধানে এই ধারা যুক্ত করা হয় যে, কেউ বিদেশি বিয়ে করলে কিংবা তাঁর সন্তান বিদেশি নাগরিক হলে তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। প্রকৃতপক্ষে সু চিকে সামনে রেখেই এই আইন করা হয়।
এরপর ২০১০ সালের নির্বাচন সু চির এনএলডি বর্জন করলে সেনানিয়ন্ত্রিত ইউএসডিপি প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়। কিন্তু ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক চাপে থেইন সেইন সু চির সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসেন এবং ক্ষমতাসীন দলে ছেড়ে দেওয়া ৪৫টি আসনে উপনির্বাচন করে এনএলডি ৪৩টিতে জয়ী হয়। সু চি হন বিরোধী দলের নেত্রী। সেই থেকে সু চি সংবিধান সংশোধন এবং জনগণের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন। কিন্তু তাঁর এই আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। সরকারের নানা উসকানির মুখেও তিনি কখনো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি নেননি। তিনি জানেন, জনগণ তাঁর সঙ্গে আছে, এবং নির্বাচনে সেটাই প্রমাণিত হলো। মিয়ানমারের নির্বাচনের সঙ্গে একমাত্র ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তুলনা করা যায়। সত্তরের নির্বাচন ছিল ছয় দফা তথা জনগণের স্বাধিকারের পক্ষে গণভোট। আর এবারে মিয়ানমারের নির্বাচনটি ছিল গণতন্ত্রের পক্ষে গণভোট। মিয়ানমারের মানুষ যে দীর্ঘ সামরিক শাসনে ক্ষুব্ধ, তারই প্রতিফলন ঘটেছে নির্বাচনে। ক্ষমতাসীনেরা গত কয়েক বছরের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, বিদেশি বিনিয়োগ ইত্যাদি বলে জনগণের ভোট টানতে চেয়েছে। কিন্তু তঁারা নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের পক্ষেই রায় দিয়েছে।
মিয়ানমারের নির্বাচনে একদিকে ছিল জনগণ, জনগণের নেত্রী অং সান সু চি এবং তাঁর দল। অন্যদিকে ছিল গোটা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, জেনারেল, অধস্তন সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণেরই জয় হয়েছে। হিংসার বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছে অহিংসা ও সহিষ্ণুতা। ঘৃণার বিরুদ্ধে শান্তি। জবরদস্তির বিরুদ্ধে নমনীয়তা।
এই চারটি নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। বাংলাদেশের মানুষও এ রকম একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই প্রার্থনায় সাড়া দেবেন কি?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.