ইউরোপজুড়ে অভিযান- নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩২

প্যারিসের বাতাক্লঁ কনসার্ট হলে নির্বিচারে
গুলির সময় গান করছিল মার্কিন গানের দল
ইগলস অব ডেথ মেটাল। এই দলটির সঙ্গে
যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক নিক আলেক্সান্ডার।
সেখানে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি একজন।
নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে গতকাল তাঁর
এক বন্ধুর আহাজারি l ছবি: রয়টার্স
শুক্রবার রাতের সন্ত্রাসে হতভম্ব প্যারিস গতকাল রোববারও শোকে মুহ্যমান ছিল। ফরাসিরা স্মরণ করেছে হারানো স্বজনদের। শ্রদ্ধা জানিয়েছে তাঁদের প্রতি। একই সঙ্গে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে ইউরোপজুড়ে চলছে অভিযান।
এরই মধ্যে তিন হামলাকারীর পরিচয় শনাক্ত করেছে ফরাসি পুলিশ। এদের একজনের বাবা ও ভাইসহ ছয় নিকটজনকে আটক করা হয়েছে। শনাক্ত হওয়া তিনজন পরস্পরের ভাই হতে পারে বলে জানিয়েছে ফরাসি গণমাধ্যম।
হামলায় ব্যবহৃত একটি গাড়ি পাওয়াগেছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। এর মধ্যে ছিল কয়েকটি একে-৪৭ রাইফেল। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, হামলাকারীদের কেউ কেউ হয়তো পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
ফরাসিরা যখন এসব তৎপরতায় ব্যস্ত, তখন বিশ্বনেতারা এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে ফরাসি জনগণের পাশে তাঁরা আছেন। লড়াই চালিয়ে যাবেন এই হামলার দায় স্বীকার করা আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে। তুরস্কের আনাতোলিয়ায় গতকাল রোববার থেকে শুরু হওয়া জি-২০ সম্মেলনে জড়ো হওয়া নেতারা সমস্বরে এ কথাই জানিয়েছেন।
দুই দিন আগের ভয়াবহ হামলা এবং দেশে জরুরি অবস্থা চলায় জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেননি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। খবর এএফপি ও রয়টার্সের।
আরও তিনজনের মৃত্যু: প্যারিসের ছয়টি স্থানে শুক্রবারের ওই হামলায় আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন গতকাল মারা গেছেন। এ নিয়ে নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৩২ জন। এঁদের মধ্যে ফরাসি ছাড়াও আছেন ১৪টি দেশের ২২ জন। এসব দেশের মধ্যে বেলজিয়াম ও চিলির তিনজন করে; আলজেরিয়া, পেরু, রোমানিয়া ও তিউনিসিয়ার দুজন করে এবং যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, মেক্সিকো, মরক্কো, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও সুইডেনের একজন করে।
গতকাল পর্যন্ত ১০২ জনের মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানান ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভল্‌স। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এখন যুদ্ধের মধ্যে আছি। যুদ্ধের মতোই সংগঠিতভাবে আমাদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। আমরাও এর সমুচিত জবাব দেব। অবশ্যই সেটা ফ্রান্সে ও ইউরোপে; সিরিয়া এবং ইরাকেও।’
শোক ও স্মরণ: ফ্রান্সে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোকের দ্বিতীয় দিন ছিল গতকাল রোববার। সাপ্তাহিক ছুটির এই দিনেও বন্ধ ছিল প্যারিসের বিখ্যাত জাদুঘর ও থিয়েটারগুলো। লোকজন খুব একটা বের হয়নি ঘরের বাইরে। তবে এর মধ্যে রাস্তাঘাটে কড়াকড়ি নিরাপত্তা ও তল্লাশি ছিল জোরালো। সেনাবাহিনী ও পুলিশের শত শত সদস্য টহল দেন রাজপথ ও মেট্রো স্টেশনগুলোতে।
এর মধ্যেও প্যারিসের প্লস দো রিপাবলিক স্কয়ারে গতকাল দিনভর জড়ো হয় শত শত মানুষ। সেখানে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে অনেক মানুষ হামলাস্থলে ফুল দেয়, মোমবাতি জ্বালায়। এই জায়গাটি শুক্রবারের হামলার মূল স্থল দাতাক্লঁ কনসার্ট হলের খুব কাছে। স্থানীয় সময় সন্ধ্যার দিকে সেখানে কিছুটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গুলির শব্দ শোনার কথা বলে সেখানে জড়ো হওয়া লোকজন। এরপর লোকজন দ্রুত সরে পড়ে। তবে তেমন কিছু ঘটেনি বলে জানায় পুলিশ।
আর নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে প্যারিসের নটর ডেম ক্যাথিড্রালে গতকাল সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় প্রার্থনাসভার। সেখানে যোগ দেয় কয়েক হাজার মানুষ।
এদিকে হামলার পর জারি করা জরুরি অবস্থা তিন মাস বলবৎ রাখতে চান ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। আধা সামরিক বাহিনীর একটি সূত্রের বরাতে এ তথ্য জানা গেছে। তবে ১২ দিনের বেশি জরুরি অবস্থা রাখতে গেলে পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
ফরাসিদের পাশে আছে বিশ্ব: আইএস হামলার দায় স্বীকার করে প্যারিসে আরও হামলার হুমকি দিলেও তার কড়া জবাব দিয়েছে ফ্রান্স। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এখন আইএসবিরোধী লড়াইয়ের জন্য আরও দ্বিগুণ সক্রিয় হবে তাঁর দেশ। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছেন। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের অবস্থানগুলোর ওপর রোববার জোরদার বিমান হামলা চালানো হয়েছে। পেন্টাগন সূত্র জানিয়েছে, আইএসবিরোধী লড়াইয়ের ‘জোরালো পদক্ষেপ’ নিতে সম্মত হয়েছেন ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা।
ফ্রান্সবাসীর শোকের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সুপরিচিত স্থাপনাগুলো ফরাসি পতাকার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। এর মধ্যে ছিল লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ, বার্লিনের ব্রান্ডেনবার্গ গেট ও নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে ফরাসি দূতাবাসসহ বিভিন্ন স্থানে ফুল দিয়ে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে প্যারিসের নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় মানুষ।
এদিকে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান–বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো তার ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল রাতে আয়োজিত কনসার্ট অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে।
একে-৪৭সহ কালো গাড়ি জব্দ: ফ্রান্সের বিচার বিভাগীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, প্যারিসের উপকণ্ঠ মঁত্রাই এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি কালো রঙের সিয়াট গাড়ি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছিল কয়েকটি একে-৪৭ রাইফেল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শুক্রবার রাতে কয়েকটি হামলাস্থলে তাঁরা এই রঙের একটি সিয়াট গাড়ি থেকে গুলি ছুড়তে দেখেছেন।
প্যারিসের পূর্বাংশে লা বেল একিপ নামের পানশালায় বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হয় ১৯ জন। সেখানেও এমন একটি কালো সিয়াট গাড়ির পেছন দিক থেকে গুলি ছুড়তে দেখেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
সবচেয়ে বেশি ৮৯ জন নিহত হয় বাতাক্লঁ কনসার্ট হলে। সেখানে বন্দুকধারীরা একে-৪৭ রাইফেল থেকে নির্বিচারে গুলি চালায় বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া একটি রেস্তোরাঁ ও বারে হামলার সময় এই রঙের কালো সিয়াট গাড়ি থেকে গুলি ছুড়তে দেখেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
হামলায় জড়িত তিন ভাই!: হামলার ঘটনায় জড়িত তিনজনকে শনাক্ত করার কথা জানা গেছে। এঁরা তিনজনই ফরাসি নাগরিক। তবে দুজন ব্রাসেলসে থাকতেন। একজন থাকতেন প্যারিসে। প্যারিসে যিনি থাকতেন, তাঁর নাম ওমর ইমলাইল মোস্তফে। গতকাল পুলিশ জানায়, ওমর ইসমাইলের বাবা ও ভাইসহ ছয়জনকে আটক করা হয়েছে।
ব্রাসেলসে যে দুজন থাকতেন তাঁদের মধ্যে আবদেসা​েলম সালেহ নামের একজনের ছবি প্রকাশ করেছে ফ্রান্সের পুলিশ। তিনিও হামলায় অংশ নিয়ে পালিয়ে যান বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া দাতাক্লঁ কনসার্ট হলে হামলাকারী নিহত এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করার কথা জানা গেছে গত রাতে। এঁরা তিনজন ভাই বলে জানিয়েছে ফরাসি গণমাধ্যম। তবে ফরাসি পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।
অভিযান ইউরোপজুড়ে: শুক্রবারের হামলায় অংশ নেওয়া সাতজনের মধ্যে ছয়জন বিস্ফোরণে নিজেদের উড়িয়ে দেয়। আর একজন নিহত হয় পুলিশের গুলিতে। এতগুলো মানুষ এমন সুসংগঠিত হয়ে কীভাবে হামলা চালাতে পারল, সেটাই এখন খুঁজে দেখা হচ্ছে।
পুলিশ বলেছে, হামলাকারীদের কাজ দেখে মনে হয়েছে, প্রশিক্ষণ দিয়ে অনেক দিন ধরে তাদের তৈরি করা হয়েছে। এমনও হতে পারে, তারা সিরিয়ার যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ আগেই বলেছেন, দেশের বাইরে প্রস্তুতি নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে এই হামলা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সের ভেতর থেকেও সহযোগিতা পেয়েছে হামলাকারীরা।
ধারণা করা হচ্ছে, হামলাকারীদের কেউ কেউ ফ্রান্সে ঢোকে আশপাশের দেশ থেকে। সেই ধারণা থেকে ইউরোপের অনেকগুলো দেশে চালানো হচ্ছে অভিযান। এরই মধ্যে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস থেকে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করেছে সে দেশের পুলিশ।
বেলজিয়ামের বিচারমন্ত্রী কোয়েন গিনস জানান, প্যারিসের বাতাক্লঁ কনসার্ট হলের কাছে একটি পোলো গাড়ি পাওয়া গেছে। ওই গাড়িটি ভাড়া করা হয়েছিল বেলজিয়াম থেকে। এই সূত্র ধরেই এখানে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
এ ছাড়া নিহত এক হামলাকারীর মৃতদেহের কাছে সিরিয়ার একটি পাসপোর্ট পাওয়ার পর গ্রিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই পাসপোর্টধারী ব্যক্তিটি একজন সিরীয় নাগরিক। গত অক্টোবরে শরণার্থী হিসেবে তিনি আসেন লেরোস দ্বীপে।
৫ নভেম্বর জার্মানির ব্যাভারিয়া এলাকায় মেশিনগান, হাতবন্দুক, বিস্ফোরকবোঝাই গাড়িসহ এক ব্যক্তিকে আটক করেছিল পুলিশ। প্যারিসে হামলার সঙ্গে ওই ব্যক্তির যোগসূত্র থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.