বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে by অ্যালিন স্মিথ

দক্ষিণ-মধ্য এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে শুধু এ বছরই কমপক্ষে ৪ জন নাস্তিক ব্লগারকে চাপাতি দিয়ে হত্যা করেছে হামলাকারীরা। সব থেকে সাম্প্রতিক পৃথক দুটি হামলার ঘটনায় ধর্মনিরপেক্ষ প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা ও অপর তিনজনকে গুরুতর আহত করা হয়। তারাও ব্লগার ও প্রকাশক ছিলেন। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় প্রতিবাদ হয়েছে। শত শত মানুষ সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছে। প্রতিবাদে লেখক ও প্রকাশকরা বই পুড়িয়েছেন। দায়েশের (আইএস) বিরুদ্ধে বিশ্বের যুদ্ধ যখন আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনামে নিয়মিত স্থান করে নিচ্ছে, তখন বিশ্বজুড়ে অনেক সংঘাত ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রায় নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে অব্যাহত রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রভাব নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মানুষদের খুঁজে পেতে আমাদের অনেক দূরে তাকাতে হবে না। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ফরেইন অ্যাফেয়ার্স কমিটিকে স্কটল্যান্ডের সদস্য হওয়ার সুবাদে, স্কটল্যান্ডে বসবাসরত বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। এদের মধ্যে সব থেকে বর্ষীয়ান সদস্য হলেন আবেরদিন নিবাসী হাজি নুরুল আমিন শেখ। তিনি ১৯৬০ সালে স্কটল্যান্ডে এসেছিলেন। আনুমানিক ধারণা অনুযায়ী, কয়েক হাজার বাংলাদেশি স্কটল্যান্ডে বসবাস করেন। তবে স্কটল্যান্ডে প্রথম আসা বাংলাদেশি প্রজন্মের বয়সের কারণে বর্তমানে স্কটল্যান্ডে জন্ম নেয়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়ছে। স্কটস-বাংলাদেশি সম্প্রদায় তুলনামূলক ছোট হতে পারে। কিন্তু তারা সরব। তাদের নিজ দেশ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ইতি টানতে পারে এমন যেকোন সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, জঙ্গিবাদী সহিংসতার ভীতি বাড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ব্যাপক সহিংসতা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আর গণতন্ত্রকে হুমকি দিচ্ছে। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশে ১৫ কোটি মানুষের বাস। বিশ্বের অল্পসংখ্যক মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতন্ত্র হিসেবে দেশটির স্বতন্ত্র স্থান রয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের মতপার্থক্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ ক্রমেই সঙ্কুচিত করার দিকে নিয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ তৈরী পোশাক শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সহিংসতা। একইসঙ্গে তা দেশের ভাবমূর্তিকে ধ্বংস করেছে যে, দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও দেশটির গড় আয়ু, শিক্ষা ও নারী-পুরুষের সমতার বিষয়গুলোতে অসামান্য অর্জন করছে। বিরোধীদের জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর থেকে, সরকারি বাহিনী আর বিরোধী মিলিট্যান্টদের হাতে শত শত মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে গুম, হত্যা, ঢালাও গ্রেপ্তারের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বিরোধী নেতা, সমর্থকদের বিরুদ্ধে বাহিনীগুলো এসব কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য বাহিনীর সদস্যরা দায়মুক্তি সুবিধা পাচ্ছে। আর এসব কিছু ঘটেছে যখন কিনা বেড়ে চলেছে ধর্মীয় উত্তেজনা। এটা নাজুক সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। আমাদের বৈঠকে যোগ দেয়া ২০ সদস্যের বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলের বক্তব্যে পরিস্থিতির গুরুতর অবস্থা আর জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আবশ্যকতা ফুটে উঠেছে। ওই বাংলাদেশিরা এসেছেন স্কটল্যান্ডের সকল প্রান্ত থেকে। তাদের অনেকে সফল ব্যবসায়ী এবং আমাদের সমাজের সক্রিয় সদস্য। সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত তারা। বাংলাদেশের সামাজিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হলো পরিবার। একইভাবে তা স্কটস-বাংলাদেশি সংস্কৃতিরও কেন্দ্রীয় অংশ। পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর দেশে যাদেরকে ফেলে এসেছেন তাদের জন্য উদ্বেগের মাত্রা আরও অনেক বেশি। আমাদের বৈঠকে আমরা সুশীল সমাজের ওপর ক্রমবর্ধমান বিধি-নিষেধের বিষয়ে আলোচনা করেছি। কথা বলেছি, মতপ্রকাশ ও বাক-স্বাধীনতার ওপর অগ্রহণযোগ্য সীমাবদ্ধতা আর গুমের অসংখ্য ঘটনা নিয়ে। এর মধ্যে বিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের গুমের ঘটনা রয়েছে। বাংলাদেশে বিরোধীদের কণ্ঠ যে অনেক বেশি ঝুঁকিতে তা স্পষ্ট। দলগুলো অব্যাহতভাবে ঝুঁকি ও হামলার মুখে নিজেদের আবিষ্কার করেছে। বাংলাদেশের সংকট নিয়ে কিছু করার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংকল্প দেখে আমি অভিভূত। কিন্তু এর কোন সহজ উত্তর নেই। আমি তাদের উদ্বেগের কথা ব্রাসেলসে উত্থাপন করেছি। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এবং ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিস মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর তীব্র নিন্দা জানায়; এর পেছনে যে কোন দেশ বা সরকারকে দোষী মনে করা হোক না কেন! বাংলাদেশে ২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা ও অস্থিরতার ক্ষেত্রেও তেমনটা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্য অংশীদার হলো ইইউ। আর আমরা বাংলাদেশি পণ্যের সব থেকে বড় রপ্তানি বাজার। আমাদের আরও বেশি কিছু করা উচিত। যে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, ঢালাও গ্রেপ্তার এবং বিরোধী নেতা, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও সামাজিক মিডিয়ায় প্রচারণাকারীদের বেআইনিভাবে কারারুদ্ধ করার ঘটনা বাড়ছে, সেখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রচারণায় আমাদের কিছু হলেও প্রভাব থাকা উচিত। এ কারণে আমি ইইউ ফরেইন অ্যাফেয়ার্স প্রধান ফেডেরিকা মোঘারিনিকে লিখেছি। ইসি-বাংলাদেশ সহযোগিতা চুক্তি ২০০১-এর প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। ইইউ’র সরাসরি কূটনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে জানতে চেয়েছি। আমি তার জবাবের অপেক্ষায় আছি। বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেয়ার সুযোগ ইইউ’র রয়েছে। ঢাকা ইইউ’র সঙ্গে বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু একইভাবে বাংলাদেশের সব থেকে বড় দাতা ইউকে সরকারও প্রভাবশালী একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট থেকে প্রকাশিত কর্মপরিকল্পনা (অপারেশন প্ল্যান) অনুযায়ী, বাংলাদেশ অনুদাননির্ভর নয়। অনুদান দেশটির জাতীয় প্রবৃদ্ধির মাত্র দুই শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের এবং ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে ইউকের। রয়েছে দৃঢ় সাংস্কৃতিক বন্ধন। ৫ লক্ষাধিক বাংলাদেশী ইউকেতে থাকেন। এদের বেশিরভাগই তাদের দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে একইভাবে উদ্বিগ্ন। শুধু কিছু মানুষের নয় বরং সকল ইউকেবাসীর সরকার হিসেবে ইউকে সরকারের উচিত এসব উদ্বেগ নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং প্রতিক্রিয়া দেখানো। ওয়েস্টমিনিস্টার সরকারের অন্যতম সংরক্ষিত (রিজার্ভড) ক্ষমতা হলো ‘ফরেইন অ্যাফেয়ার্স’। আমি প্রত্যাশা করি, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। আর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি বন্ধ করতে তারা বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দেবেন। এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করেছে নিরপেক্ষ অনেক পর্যবেক্ষক আর স্কটল্যান্ডের বাংলাদেশি সম্প্রদায়।  
[অ্যালিন স্মিথ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ফরেইন অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে স্কটল্যান্ডের একজন সদস্য। গতকাল স্কটল্যান্ডের দ্যা ন্যাশনাল সংবাদপত্রে ‘উই মাস্ট অ্যাক্ট টু হল্ট রাইটস ভায়োলেশনস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক তার লেখার অনুবাদ ]

No comments

Powered by Blogger.