এ দেখাই শেষ দেখা by জুনায়েত হাসান

‘জন্মভূমি ছেড়ে গেলাম। জানি না, ওখানে এমন মাতৃছায়া পাবো কি-না? হামার জন্য আশীর্বাদ চাই। হয়তো আর কোনদিন দেখা-সাক্ষাৎ হবে না। এ দেখাই শেষ দেখা।’ পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ১১৯ নম্বর বাঁশকাটা ছিটমহলের বর্মণপাড়ার সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী ইদ্রিস আলীকে এসব কথা বলেই বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন ষাটোর্ধ্ব উকল চন্দ্র বর্মণ। গতকাল সকালে নিজের জন্মভিটা বর্মণপাড়া থেকে চিরকালের জন্য ভারতের নয়া ঠিকানার উদ্দেশে চলে যান তিনি। ভারতে চলে যাওয়া বিলুপ্ত ৪টি ছিটমহলের ৩০টি পরিবারের ১২৯ ট্রাভেল পাসধারীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। চার ছেলে ও তিন মেয়ে তার। এক ছেলেকে বাংলাদেশেই বিয়ে দিয়েছেন। আর ৩ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ভারতের কোচবিহার জেলার ধুবগুড়ি ও নয়ারহাট এলাকায়। তিনি ৪ ছেলে, স্ত্রী ও তার ছেলের স্ত্রীকে নিয়ে যান। মেয়েরা আগে থেকে ভারতে স্বামীর বাড়ি রয়েছেন।
বিচ্ছেদের কান্না শুধু উকিল বর্মণের একার নয়। তার মতো ১১৯ নম্বর বাঁশকাটা ছিটমহলের বর্মণপাড়ার স্কুলছাত্রী সুচরিতা রানী বর্মণ, জোসনা রানী বর্মণ, সুমন চন্দ্র বর্মণসহ অন্য সবার। তাদের কান্নায় ১১৯ নম্বর বাঁশকাটা, ১১২ নম্বর বাঁশকাটা, ১১৫ নম্বর বাঁশকাটা ও ১৫ নম্বর খরিখরি ছিটমহলের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ভারতে চলে যাওয়াদের কান্নায় স্থানীয় প্রতিবেশীরাও আবেগাপ্লুত। এ সময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
দুপুর ১টায় বুড়িমারী স্থলবন্দর পুলিশ ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম শেষে জিরোপয়েন্টে পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর কুতুবুল আলম ভারতের নয়া ঠিকানায় যাওয়া এসব নাগরিককে মিষ্টিমুখ করান এবং রজনীগন্ধার একটি করে স্টিক হাতে তুলে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানান। এ সময় পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমীন বাবুল ও জোংড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ মাহমুদুন্নবী শাহীন উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, ভারতের কোচবিহার অতিরিক্ত জেলা শাসক আয়শা রানী ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সচিব রামাকান্ত গুপ্তা উপস্থিত থেকে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের মিষ্টিমুখ করিয়ে হাতে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। এ সময় পাশেই স্থাপিত মঞ্চে ভারতীয় শিল্পীরা নয়া নাগরিকদের গানে গানে বরণ করে নেন।
চিলাহাটি সীমান্ত দিয়ে ভারত গেলেন
ডোমার (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, নীলফামারীর চিলাহাটি থেকে দুই দিনে ভারত গেলেন সদ্য বিলুপ্ত ৫ ছিটমহলের ২২৪ বাসিন্দা। রোববার বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে প্রথম দফায় চিলাহাটি হলদিবাড়ী সীমান্ত দিয়ে কুচবিহার জেলার এডিএম আয়শা রানীর কাছে ৪৮ বাসিন্দাকে হস্তান্তর করেন নীলফামারী জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মজিবুর রহমান। গতকাল দ্বিতীয় দফায় যান ১৭৬ বাসিন্দা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ৫৮ ব্যাটালিয়নের ডেপুটি কমান্ডার এ কে ঝা, ভারত জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন রঞ্জন ঝা, বিজিবির ৫৬ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জিএম সারোয়ার, ডোমার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বসুনিয়া, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবিহা সুলতানা প্রমুখ। এর আগে দুপুরে ভারত গমনে পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলের প্রথম দলের ২২৪ সদস্যের ইমিগ্রেশন নেয়া হয় ডোমার উপজেলার চিলাহাটি সীমান্তের আবদুর রউফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চত্বরে। ইমিগ্রেশন কাজে ছিলেন কাস্টমসসের সহকারী কমিশনার হুমায়ুন হাফিজ, রাজস্ব কর্মকর্তা আহসান হাবিব, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ময়নুল ইসলাম, ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন অফিসের ফাস্ট সেক্রেটারি রমাকান্ত গুপ্ত, নীলফামারীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মুজিবুর রহমান, ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জিএম সারোয়ার, ডোমার উপজেলার চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বসুনিয়া, ডোমার নির্বাহী কর্মকর্তা সাবিহা সুলতানা, পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল, ডোমার থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ।
দুই দিনে ৫টি বাসযোগে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার কালিয়াগঞ্জ ইউপি চত্বরের অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে দুপুর ১২টা ৩৪ মিনিটে চিলাহাটি আবদুর রউফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চত্বরে নিয়ে আসা হয়। এখানে তাদের বরণ করতে নীলফামারীর জেলা প্রশাসনের পক্ষে রজনীগন্ধার একটি করে স্টিক হাতে তুলে দেয়া হয়। তাদের ইমিগ্রেশন শেষে তাদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তরের সময় দুই সীমান্তে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন। এখানে তাদের শেষ বিদায় জানাতে আত্মীয়স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।
কান্না থামছে না বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর
পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, কান্না থামছে না বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর। আপনজনদের মধ্যে কেউ কেউ যাচ্ছেন ভারতে। কেউ কেউ থেকে যাচ্ছেন বাংলাদেশে। এ অবস্থায় বিদায়বেলায় উভয়ই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। দ্বিতীয় দফায় গতকাল ভারত গেছেন পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার বিলুপ্ত কোটভাজনী ও বালাপাড়া খাগড়াবাড়ী ছিটমহলের ২৮টি পরিবারের এক নবজাতকসহ ১৪৭ সদস্য। এ দুটি ছিটের ৩১ পরিবারের ১৭৭ জন ভারতে যাওয়ার কথা থাকলেও প্রস্তুতি না থাকায় ৩০ জন চতুর্থ দফায় ভারতে যাবেন বলে জানা গেছে। সকাল সাড়ে ৯টায় দেবীগঞ্জের গাজোকাটি বাজার মাঠের অস্থায়ী ক্যাম্পে পঞ্চগড়ের এডিএম মোহাম্মদ গোলাম আজম ও দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শফিকুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশনারের প্রথম সেক্রেটারি রমা কান্ত গুপ্তার কাছে ১৪৭ জন নতুন ভারতীয় নাগরিকদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ তাদের হস্তান্তর করেন। পরে ৪টি মিনিবাস ও ৭টি ট্রাকে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি ডাঙ্গাপাড়া সীমান্তে। সেখানকার আবদুর রউফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম শেষ করা হয়। দুপুরে দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শফিকুল ইসলাম ভারতের কুচবিহার জেলার এডিএম আয়শা রানী ও বিএসএফের ডেপুটি কমান্ডার এ কে ঝার হাতে মালামালসহ নতুন নাগরিককে হস্তান্তর করেন। এ সময় নীলফামারীর ডোমার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাবিহা সুলতানা, ডোমার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বসুনিয়াসহ গণমাধ্যমকর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও বিজিবি সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। পরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের বরণ করে নেয়।
আজ মঙ্গলবার তৃতীয় দফায় দেবীগঞ্জ উপজেলার বিলুপ্ত দহলা খাগড়াবাড়ী ছিটমহলের ২৯টি পরিবারের এক নবজাতকসহ ১৪৯ জন ভারতে যাবেন। তারা গতকালই প্রয়োজনীয় মাল-সামানাসহ দেবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বরে স্থাপিত অস্থায়ী ক্যাম্পে উপস্থিত হয়েছেন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার দগলা খাগড়াবাড়ী ও দইখাতা ছিটমহলের ২৩টি পরিবারের ১০৮ জন সদস্য ভারতে যাবেন।

No comments

Powered by Blogger.