খাটে শুয়ে মানিক মিয়া বলতেন আর আমি লিখতাম by কাজী সুমন

প্রাথমিক শিক্ষা জীবন কাটে বরগুনায়। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তে চলে আসেন নারায়ণগঞ্জে। ওঠেন খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবারে। ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে। ভাষা আন্দোলনে সারা দেশ তখন উত্তাল। প্রতিদিন শহরের অলিগলিতে মিছিল হয়। ভাষার প্রতি আবেগ সংবরণ করতে পারেননি উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র খন্দকার মাহবুব হোসেন। যোগ দেন ওই প্রতিবাদী মিছিলে। মিছিল থেকেই পুলিশ তাকে আটক করে। এরপর তিন রাত কাটান নারায়ণগঞ্জ থানাহাজতে। ছাত্রাবস্থায় প্রথম ভোগ করেন হাজতবাস। ওই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী নটর ডেম কলেজে। তখনই জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। এতে পড়াশোনায় গ্যাপ পড়ে যায়। দুবছর পর আইএসসি পরীক্ষা দেন। ১৯৫৮ সালে পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ অ্যাসোসিয়েশনের ভিপি নির্বাচিত হন। তখন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করেন। ১০-১২ জন সহপাঠীর সঙ্গে ফের গ্রেপ্তার হন তিনি। তাদের বিচার শুরু হয় সামরিক আদালতে। নিজেই বিচারের মোকাবিলা করেন সাহসী তরুণ মাহবুব হোসেন। বিচারককে ছুড়ে দেন আইনি চ্যালেঞ্জ। ঘাবড়ে যান বিচারক। উর্দু ভাল বলতে পারার কারণে কিছুটা আনুকূল্যও পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের পরিচয় পেয়ে তাকে খালাস দেন বিচারক। তবে ছাত্রনেতা হওয়ার কারণে আইয়ুব খান তাকে এমএ পরীক্ষায় অংশ নিতে দেননি। তাই ১৯৬৪ সালে ল’ পাস করে আইন পেশা শুরু করেন। তখন থেকেই রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতাদের মামলা পরিচালনা করেন তিনি। ৬৬ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নেপথ্যে থেকে সহায়তা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের। ৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝিতে হাইকোর্টে আইনজীবীদের একটি মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দেয়ার। তখন তিনিও চাইছিলেন কিছু একটা করার। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানসহ আইনজীবীদের নিয়ে জেলা কোর্টে একটি সমাবেশের আয়োজন করেন। ওই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বক্তব্য দেন তরুণ আইনজীবী মাহবুব হোসেন। পরদিন অবজারভার পত্রিকার প্রথম পাতায় তার ছবি প্রকাশিত হয়। ওই ছবি নিয়ে গোয়েন্দারা তল্লাশি শুরু করেন। তখন ওয়ারীর হেয়ার স্ট্রিট রোডের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ওই বাসায় থাকতেন প্রয়াত জিল্লুর রহমান ও আইভি রহমান। ২৫শে মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর ওই বাসা থেকে তাদের নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যান তিনি। শুরু হয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। তখন মুক্তিযোদ্ধারা তার ওই বাসাকে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। আলমারিতে রাখা মোটা আইনি বইয়ের পেছনে লুকিয়ে রাখতেন গ্রেনেড। একদিন গ্রেনেড বহনকারী এক মুক্তিযোদ্ধা এসে বললেন, তাকে কবি জসীমউদ্‌দীনের কমলাপুরের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। ওই বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। নিজের ট্রাম্প গাড়িতে করে রওনা দেয়ামাত্রই পাক সেনারা তাদের গতিরোধ করে। পাক সেনাদের বোকা বানিয়ে ওই মুক্তিযোদ্ধাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেন তিনি। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আদালতের চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয় খন্দকার মাহবুব হোসেনকে। তরুণ বয়সে এতবড় দায়িত্ব পেয়ে ভড়কে যান তিনি। ছুটে যান তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের কাছে। কামাল হোসেন তাকে জানান, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না, আপনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। বঙ্গবন্ধু তাকে পিঠ চাপড়ে অভয় দেন। এরপর থেকে সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরীসহ প্রভাবশালী সব রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করেন। এদিকে ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার শ্যালক হওয়ায় ‘জাতীয় শ্যালকের’ পরিচিতি পান। মানিক মিয়ার কলাম লেখায় তিনি সহযোগিতা করেছেন। মানিক মিয়া নিজ হাতে লিখতেন না। প্রায় দিনই দুপুরের পর বাসায় খাটে শুয়ে থাকতেন। ইত্তেফাক থেকে লোক আসতো। তিনি যা বলতেন সেটা নোট করা হতো। যেদিন ইত্তেফাক থেকে লোক আসতো না সেদিন মাহবুব হোসেনকে ডাকতেন। খাটে শুয়ে মানিক মিয়া বলতেন আর তিনি লিখতেন। তবে বানান ভুল করলেই তার বকা খেতেন। কিংবদন্তি ওই সম্পাদকের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, মানিক মিয়ার লেখায় ম্যাজিক ছিল। রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে লিখে তাকে আবার ফোন দিতেন। রাজনীতির সেই সংস্কৃতি এখন আর নেই। আইনজীবী জীবনের অনেকটা সময় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার পর তিনি বাঙালি জাতিকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। দেশে বিভাজন চাননি। কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে মুক্তিযুদ্ধ করেনি সে বিতর্কে না গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- দেখ, আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল- ১৯৫ জন তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপে তাদের বিচার আমরা করতে পারিনি। তাদের ছেড়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্রে বিবৃতি দিলেন- বাঙালি জাতি জানে কিভাবে ক্ষমা করতে হয়। এছাড়া শুধু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার হওয়ার কারণে ৩২ হাজার লোক কলাবরেটর অ্যাক্টে পিস কমিটির মেম্বার হয়েছিলেন। কয়েকটি ধাপে তাদের ক্ষমা করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় ভুল হলো ক্ষমতায় যাওয়া। তিনি যদি ক্ষমতায় না যেতেন তাহলে সমগ্র জাতির কাছে আজ আরও উপরে থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন হচ্ছে না। যে বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন সেই আওয়ামী লীগ আজ জাতিকে বিভক্ত করেছে ফেলেছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকেও কাছ থেকে দেখেছেন মাহবুব হোসেন। একদিন গোয়েন্দা সংস্থার লোক দিয়ে তাকে বাসায় ডাকালেন। তখন প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন, খন্দকার সাহেব অনেক কিছুই করেছেন। আসুন, দেশের জন্য কাজ করি। এর জবাব দেয়ার জন্য কয়েক দিনের সময় চেয়ে চলে আসেন মাহবুব হোসেন। পরে অনেক দিন যাননি। ওদিকে গোপনে জিয়াউর রহমান তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির খোঁজ নিলেন। তার সাধারণ জীবনযাপনের তথ্য পেয়ে ফের তাকে ডাকলেন। বাসায় যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন, খন্দকার সাহেব কি চিন্তা-ভাবনা করলেন। জবাবে তিনি রাজনীতিতে না আসতে মায়ের অনীহার কথা জানান এবং বলেন, আমি আইনজীবী মানুষ। আপনার মামলার কোন সহায়তা লাগলে আমাকে বলবেন। এ কথা শুনেই প্রেসিডেন্ট জিয়া দাঁড়িয়ে গেলেন। হেসে দিয়ে বলেন, আমার মামলা পরিচালনার সুযোগ আপনি পাবেন না। জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর তার ওই কথাটি চরমভাবে পীড়া দেয় তাকে। যা নিয়ে এখনও দুঃখ করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। ৫৫ বছরের আইন পেশায় দেশের প্রথম সারির সব রাজনীতিবিদের মামলা পরিচালনা করেছেন তিনি। কিন্তু সত্যি সত্যি জিয়াউর রহমানের মামলা পরিচালনার সুযোগ পাননি মাহবুব হোসেন। তবে আইনজীবী হিসেবে সারা জীবন কাটালেও পড়ন্ত বেলায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৮ সালে যোগ দেন বিএনপিতে।  বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। একইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির চার চারবার নির্বাচিত সভাপতি তিনি। ১৯৩৮ সালে ২০শে মার্চ বরগুনার বামনায় প্রখ্যাত এ আইনজীবীর জন্ম। পিতা খন্দকার আবুল হাসান শিক্ষাবিদ ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ে করেছেন অধ্যাপিকা ফারহাত হোসেনকে। দুই ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের জনক তিনি। সমাজসেবায় বহুমুখী অবদান রাখছেন। অন্ধ ও পঙ্গুদের জন্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (ভিটিসিবি)-এর ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি তিনি। শিশু সংগঠন কচিকাঁচার উপদেষ্টা এবং জসীমউদ্‌দীন পরিষদের সম্মানিত পৃষ্ঠপোষক। ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড ইউনিয়ন, এশিয়ান ব্লাইন্ড ইউনিয়ন ও ঢাকা রোটারি ক্লাবের সদস্য। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন মেধাবী এই আইনজীবী। জসীমউদ্‌দীন স্বর্ণপদক (২০০৬), কবি নজরুল স্বর্ণপদক (২০০৭), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক (২০০৮) পান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.