ঢাকাকে বাঁচাতে চাই রাজনৈতিক অঙ্গীকার

প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য
দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক।
পাশে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম
প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠক: জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন মনে করেন ঢাকার দুই মেয়র ও নগর পরিকল্পনাবিদেরা
জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনে কার্যকর সমন্বিত ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন ঢাকার দুই মেয়র। আর ঢাকাকে রক্ষার জন্য নেওয়া কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের কাছে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রত্যাশা করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদেরা।
গতকাল শনিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘জলজট-যানজটে বিপন্ন ঢাকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই অভিমত দিয়েছেন আলোচকেরা। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এই আলোচনায় অংশ নেন এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, বুয়েটের অধ্যাপক ও হাতিরঝিল প্রকল্পের পরামর্শক মো. মুজিবুর রহমান, বেলার নির্বাহী পরিচালক পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ জামান। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘বৃষ্টির পানি নর্দমা দিয়ে খালে পড়বে। সেখান থেকে নদীতে যাবে। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু সিটি করপোরেশন সব নর্দমার মালিক নয়। ওয়াসার নিয়ন্ত্রণে ৬০০ কিলোমিটার নর্দমা। লেকগুলোর মালিক জেলা প্রশাসন। সেখানে সিটি করপোরেশনের কিছু করার নেই। আমি নিজে ঘুরে দেখেছি, ডিএনসিসির মধ্যে রূপনগর খাল, কল্যাণপুর খাল কিছুদূর যাওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল ভরাট। তুরাগ নদ, বালু নদে চলছে দখল। নর্দমা ভরাট করে স্থাপনা। ওয়াসা, রাজউকসহ বিভিন্ন সংস্থা সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত নয়। তারা আমাদের কথা কেন শুনবে? একটি ছাতার আওতায় সংশ্লিষ্ট সবগুলো সংস্থাকে এনে সমন্বিত তত্ত্বাবধানে কর্মসূচি নেওয়া ছাড়া স্থায়ী ও ফলপ্রসূ সমাধান সম্ভব নয়।’
আনিসুল হক বলেন, ‘এরপরও আমরা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে জলজট ও যানজট নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছি। অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হচ্ছে।’ দুই বছরের মধ্যে গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনের ফল পাওয়া যাবে বলে তিনি নগরবাসীকে আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) আসিফ মোহাম্মদ জামান, মো. মুজিবুর রহমান, সাঈদ খোকন, জামিলুর রেজা চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, মোবাশ্বের হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং আব্দুল কাইয়ুম l ছবি: প্রথম আলো
ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকনও সমস্যা সমাধানে সমন্বিত প্রয়াসের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘টাস্কফোর্স’ বা যে নামেই হোক, অনতিবিলম্বে এটা করা দরকার। তিনি বলেন, ‘১ সেপ্টেম্বর শহরজুড়ে যে জলজটের সৃষ্টি হয়েছিল, তা আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। একটি বিপৎসংকেত। কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আগামী বর্ষায় যে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, এই আশঙ্কা আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা ডিএসসিসির পক্ষ থেকে ২৯ আগস্ট জলজট নিরসনের লক্ষ্যে নগর ভবনে বিশেষজ্ঞ ও সংশিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিয়ে একটি সেমিনার করেছি। সেখানে যে সুপারিশ করা হয়েছে, তার আলোকে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করার মতো টাস্কফোর্স করার এখতিয়ার সিটি করপোরেশনের নেই। এই প্রকল্প প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়েছে। আশা করি, তিনি তা অনুমোদন করবেন। তবে এর মধ্যেই আমরা ভূ-উপরিস্থ নর্দমার সংস্কারসহ স্বল্প মেয়াদের কাজগুলো করছি। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নর্দমা পরিষ্কার করার কর্মসূচি নিয়েছি। আশা করা যায়, আগামী বর্ষায় এবারের চেয়ে অন্তত শতকরা ৫০ ভাগ জলজট কমবে।’ তবে তিনি বলেন, বর্ষার সময় গণমাধ্যমসহ সবাই জলজট নিয়ে যেভাবে সোচ্চার থাকেন, আলোচনার মধ্যে থাকেন, তা অব্যাহত রাখতে হবে। বর্ষা চলে গেলে বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না। ধারাবাহিকভাবে সবাইকে এই নাগরিক সমস্যার বিষয়গুলো নিয়ে লেগে থাকতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুসারে বিশেষজ্ঞ ও সুধীজন—সবাইকে নিয়ে সবার মতামতের ভিত্তিতে তিনি কাজ করার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তা অব্যাহত থাকবে।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী জোর দিয়েছেন ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) নির্দেশিত বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল, প্রাকৃতিক জলাধার, খাল ও নদীগুলোকে মুক্ত এবং সচল রাখার প্রতি। তিনি বলেন, ‘১ সেপ্টেম্বরের ধাক্কা কোনো ধাক্কাই নয়, সামনে আরও বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছে। তখন নৌকা নিয়ে চলতে হবে। কাজেই ঢাকাকে বন্যামুক্ত রাখতে হলে বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলকে মুক্ত রাখার কোনো বিকল্প নেই। খাল-নদী উদ্ধার করতেই হবে।’ তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা ও দৃঢ়তার প্রয়োজন। যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা লোক দেখানো। প্রকৃত কোনো কাজ হয় না। এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে হবে। এখনো যেটুকু বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল মুক্ত আছে, জরুরি ভিত্তিতে তা সংরক্ষণ করতে হবে।
এর পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রতিও জোর দেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, যত্রতত্র আবর্জনা না ফেলার প্রতি নগরবাসীকে সচেতন করে তুলতে হবে। নর্দমার প্রবাহ বন্ধের একটি বড় কারণ পথের আবর্জনা। নর্দমাগুলোও ঢেকে দিতে হবে, ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি বন্ধের জন্য তিনি ফেরো সিমেন্টে তৈরি ঢাকনা ব্যবহারের সুপারিশ করেন।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতপক্ষে ঢাকার কোনো অভিভাবক নেই। প্রথমত, এটা দরকার। এরপর বিষয়ভিত্তিক এবং সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আলাদা টাস্কফোর্স করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সরকার যে গুরুত্ব দিয়েছে, ঢাকাকে রক্ষার বিষয়টিও একই রকম গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। তবে তার আগে এলাকার বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ছোট ছোট কমিটি করে কাজ শুরু করার জন্য তিনি মেয়রদের পরামর্শ দেন। তিনি মেয়রের নেতৃত্বে কাউন্সিলরদের সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত আলোচনার মধ্য দিয়ে তাঁদের কারিগরি বিষয়ে অবহিত করে তোলারও পরামর্শ দেন।
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন গুরুত্ব দিয়েছেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি। তিনি বলেন, আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব। তবে তার আগে আইন প্রয়োগের ব্যাপারে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে হবে। ড্যাপকে পাশ কাটিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভূমি উন্নয়নের অনুমোদন দেওয়া হলো। রাজউক নিজেই খাল-নালা, বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল ভরাট করে প্লট বিক্রি করছে। আবাসনের ব্যবস্থা করাই যদি তাদের লক্ষ্য হয়, তাহলে প্লট বিক্রি না করে তারা ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারত। সেটাই যুক্তিসংগত হতো। এখন টাস্কফোর্স করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই টাস্কফোর্সকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট হতে হবে। এ ক্ষেত্রে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে কমিটি করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। সেখানে জনপ্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাহলে তাঁরা জনস্বার্থ রক্ষার বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারবেন। না হলে কোনো কাজ হবে না।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় যে ভালো কাজ করা যায়, হাতিরঝিল প্রকল্প তার একটি চমৎকার উদাহরণ। ঢাকার অন্য খালগুলোতেও এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে জলাধার সংরক্ষণ করার সুযোগ রয়েছে। তবে ওয়াসা এখন যেভাবে খালের পাড় বেঁধে দিয়ে নালায় পরিণত করতে যাচ্ছে, তাতে খালগুলো তো হারিয়ে যাবেই, পাড়বাঁধা নর্দমাগুলোও দূষণ ও জলাবদ্ধতার আরেক উৎস হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই অনেক ক্ষেত্রে সেই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, বক্স কালভার্ট খুলে দিয়ে জমাট আবর্জনা অপসারণ করতে হবে। এ ছাড়া ওয়াসা যে ১৩টি বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে, তার সঙ্গে বর্জ্য সংগ্রহ ও শোধনাগারে প্রেরণের পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনাও (নেটওয়ার্ক) তৈরি করতে হবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর আমাদের শুনতে হচ্ছে ঢাকা ওয়াসা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় মাত্র ২২ শতাংশ সেবা দিতে পারে। তাহলে প্রশ্ন আসে, এই দায়িত্বে তাঁদের থাকার যৌক্তিকতা কোথায়? চার দশকে যদি শতকরা অন্তত ৫০ ভাগের কথাও তাঁরা বলতেন, তাহলে তাঁদের ভূমিকার একটি যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যেত। এদিকে ভূমি উন্নয়নকারীরা ড্যাপকে পাশ কাটিয়ে একের পর এক খাল-নদী, জলাভূমি ভরাট করে যাচ্ছে। আমরা বহু কথা বলেছি এসব নিয়ে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। পরিকল্পনা যা-ই করা হোক, আগে একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। প্রয়োজন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।’
আসিফ মোহাম্মদ জামান বলেন, ‘ঢাকা মহানগরের অবস্থা এখন একটি জটিল রোগীর মতো। তার হার্টে ব্লক হয়েছে। আমরা সার্ফেস ড্রেনেজ লাইন কাটাকুটির মধ্য দিয়ে রিং লাগিয়েছি। ফ্লাইওভার করে বাইপাস করেছি। আবার বালি ফেলে নদী-খাল ভরাট করছি। এভাবে কিন্তু বেশি দিন টেকানো যাবে না। এভাবে চলতে থাকলে সামনে খবর আছে।’

No comments

Powered by Blogger.