প্রেসিডেন্ট পোস্ট অফিস নন -সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত by উৎপল রায়

প্রধান বিচারপতিকে অভিশংসনের প্রস্তাব করে প্রেসিডেন্টকে এক বিচারপতির চিঠি দেয়ার কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেছেন, এটি অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের জুডিশিয়ারির ইতিহাসে এ রকম ঘটনা আর ঘটেনি। সুপ্রিম কোর্ট সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালত। বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল। এখানে মানুষ সব সময় ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করে। সুপ্রিম কোর্টের উপরে আর কোন আদালত নেই। সুপ্রিম কোর্টের অনিবার্যতা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। এছাড়া, রাষ্ট্র অচল। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতির উপরে বিচারের ক্ষেত্রে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ নেই। এই জায়গাগুলোকে সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। তাই এটা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভাল।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনের নিজ কার্যালয়ে দেয়া এই সাক্ষাৎকারে নানা ইস্যুতে খোলামেলা কথা বলেন তিনি। মন্ত্রিসভার বাইরে থাকা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রায়শই সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করেন। প্রধান বিচারপতির অভিসংশন চেয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর চিঠি দেয়া প্রসঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বিষয়টি ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত চলে গেছে। কেউ বলছেন, এটি আইনে নেই। কিন্তু একটি কথা সবাইকে বুঝতে হবে প্রেসিডেন্ট কিন্তু পোস্ট অফিস নয়। পোস্ট অফিসে চিঠি পাঠালে তার কাজ হলো চিঠিটি পাঠিয়ে দেয়া। আর তো কোন কাজ নেই। তবে, প্রেসিডেন্ট অনেক কিছুই করতে পারেন। আমাদের বর্তমান প্রেসিডেন্ট একজন অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীও। তাই আমরা প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে কিছু কিছু ব্যাপারে সমাধান আশা করতেই পারি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিএনপির আইনজীবীরা বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ক্ষমতায় আছে। কিন্তু এ বিষয়ে তারা কথা বলছে সরকারি দলের মতো। আবার সরকারি দল রহস্যজনক কারণে নীরব। তারা চুপ করে আছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভাপতি হিসেবে আমিও এ বিষয়টির একটি পার্ট। কিন্তু এটিতো কোন গৌরবের বিষয় নয়। তবে,  বার ও বেঞ্চে অনেক অভিজ্ঞ জুরিস্টরা রয়েছেন। তাদের মধ্যস্থতায় বিষয়টি একটি মীমাংসায় উপনীত হবে বলে আমি আশা করবো।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র ওপর ভ্যাট আরোপ এবং আন্দোলনের মুখে তা আবার প্রত্যাহারের বিষয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী ভ্যাট বসিয়েছেন। বাজেট হইলো কবে, আর প্রতিক্রিয়া হইলো কবে? তারা (শিক্ষার্থী) জানে না যে ভ্যাট পাস হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া হলো বহু পরে। এখানে যে গ্যাপটা সেটা রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব। কিন্তু পরে হলেও প্রতিক্রিয়া হলো, হয়ে আকস্মিকভাবে একটি অরাজনৈতিক জায়গা থেকে আন্দোলন হলো। আমি প্রথমেই বলেছিলাম শিক্ষা ফি’র ওপর এই ভ্যাট আরোপ অনৈতিক এবং এটা তুলে নেয়া ভাল। কারণ শিক্ষা একটি অধিকার। আমি ছাত্ররাজনীতি করে এসেছি। যে কারণে আমি প্রথমেই বলতে পেরেছি। আর যারা মন্ত্রিসভায় আছে তাদের তো আর আমার মতো ফ্রিস্টাইলে কথা বলার সুযোগ নাই।’
তিনি বলেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না-কি নন প্রফিটেবল। কিন্তু নন প্রফিটেবল হলে এতদিন যে তারা প্রফিট করলো, শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কি ঘাস কাটছিল? এখানে ভালভাবে মনিটরিং দরকার ছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন প্রসঙ্গে  সুরঞ্জিত সেন বলেন, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকারের ডায়নামিক বলে কিছু কথা আছে। শেখ হাসিনার যে পার্টি এটাতো গ্যারেজের পার্টি না। রাজপথের পার্টি। এরা আন্দোলন করতেও জানে, আন্দোলন মোকাবিলা করতেও জানে। দুটি বিষয়ই তাদের জানা আছে। কত সুন্দরভাবে বিষয়টি হ্যান্ডেল করা হয়েছে। এটাকেই বলে পলিটিক্যাল ডায়নামিজম। তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলছে অর্থমন্ত্রীর ইমেজ ডাউন হয়েছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর ইমেজ ডাউন হলে কিছু আসে যায় না। প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ ডাউন হলে কিছু আসে যায়। তবে, এই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর পরাজয় হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রীর বিজয় হয়েছে। তার ইমেজ বেড়েছে। তার লাভ হয়েছে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরের বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই নেতা বলেন, এর আগে তিনি সৌদি আরব সৌদি আরব করেছেন। তারপরও ওটা হয়নি। এবার তিনি লন্ডনে গেলেন। সৌদি আরব কেন হয় নাই, আর লন্ডন কেন হলো এটা সবাই জানে। লন্ডন থেকে ওনার ছেলে যদি একবার বাইরে বের হন তবে আর লন্ডনে ঢুকতে পারবে না। এ কারণেই খালেদা জিয়া সৌদি আরব যাননি। এখন কথা হলো, তিনি (খালেদা জিয়া) লন্ডনই যাক আর সৌদি আরবই যাক, একজন রাজনীতিবিদ যখন যেখানে যান না কেন তার সব কথা, চিন্তা, চেতনা রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই। রাজনীতির বাইরে তিনি আর কিছুই পাবেন না। হবেও না।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে বিএনপির অনেক কিছুই শিক্ষণীয় আছে। শিক্ষার্থীরা তো পেট্রলবোমা ও ককটেল মারে নাই। পেট্রলবোমা, ককটেল ছাড়াও কিভাবে অহিংস আন্দোলন করা যায় তা তারা দেখিয়েছে। এই ডায়নামিজমটা খালেদা জিয়া বুঝতে পারেন না। কারণ এরা তো ব্যারাকের পার্টি। আর ব্যারাকের পার্টি দিয়ে আন্দোলন হবে না। তিনি বলেন, বিএনপি ইতিমধ্যে যে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করেছে এগুলোর জবাবদিহির প্রশ্ন তার রাজনৈতিক দলের মধ্যেই এসে গেছে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন এবং তা প্রতিহত করতে যাওয়া দলকে কতটুকু লাভবান করেছে আর কতটুকু ক্ষতি করেছে সেটাই এখন তারা (বিএনপি) হিসাব করছে। এখন আবার তিনি (খালেদা জিয়া) গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরেছেন। এই যে স্ববিরোধী আচরণ এটা তাকে শুধু জনগণ থেকেই বিচ্ছিন্ন করেনি রাজনীতি থেকেও বিচ্ছিন্ন করেছে। একই সঙ্গে দলের নেতাকর্মীরাও হতাশাগ্রস্ত। তাই এ বিষয়ে অবশ্যই চিন্তা কেবল মায়ের পুত্রের কাছে যাওয়া না, এটা রাজনীতির রাজনীতির কাছে যাওয়া।

No comments

Powered by Blogger.