বিলিভ ইট অর নট: আপনার সামনেই আপনার শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার by এম, এ, বাকী বিল্লাহ্ হৃদয়

পরিনীতা দশ বছর বয়সী শিশু। অনেক চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। তার দুরন্তপনায় সমস্ত বাড়ি মেতে থাকতো। হঠাৎ করে সে বদলে যায়। তার ব্যবহার অস্বাভাবিক মনে হয়। প্রায় সময় রুমের দরজা বন্ধ করে একা একা বসে থাকে। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলে না। পরবর্তী সময়ে জানা যায়, পরিনীতা সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার। আট বছরের ছেলে দীপ্ত। সে তাদের কাজের ছেলেটিকে ভয় পায়। তার কাছে যেতে চায় না। তারপরেও তাকে জোর করে কাজের ছেলেটির কাছে-ই রাখা হয়। দীপ্ত তার পরিবারকে জানায়, কাজের ছেলেটি তাকে প্রতিদিন ব্যাথা দেয়। কিন্তু স-বিস্তারে কিছুই বলতে পারে না সে। তাই তার কথা কেউ গুরুত্ব দিয়ে শুনে না। এভাবে-ই সে প্রায় প্রতিদিন কাজের ছেলে দ্বারা সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার হয়। মাহিমের বয়স সাত বছর। একুশ/বাইশ বছর বয়সী খালাতো ভাই সিক্রেট মজার খেলা বলে তার সাথে সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ করে। তার অনেতক কষ্ট হয়। ব্যাথা পায় খুব। কিন্তু সে বুঝতে পারে না যে, তার সঙ্গে কিরকম নোংরামি করা হচ্ছে। আধুনিকতার মোড়কে চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। চাইল্ড  সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ  (CSA) কে বলা যায়, ‘The imposition of sexual acts, or acts with sexual overtones, by one or more persons on a child (under 18) - Save the Children, CSA Droft Policy. শিশুর গোপন অঙ্গে  ইচ্ছাকৃত বা অনিশচ্ছাকৃত স্পর্শ, শিশুর সঙ্গে তার বয়স অনুপযোগী সেক্সুয়াল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, শিশুর নগ্ন ছবি তোলা বা তার সামনে নগ্ন হওয়া, শিশুকে পর্নোগ্রাফি দেখানো, তাকে ধর্ষণ করা বা ধর্ষণের চেষ্টা করা, এইসব কিছু-ই চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ। আর এই চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের মাত্রা ক্রমান্বয়ে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা জানি, চাইল্ড বা শিশু বলতে ১৮ বছর বয়সের নিচে সকল মানব সন্তানকে বুঝায়। আর এই সময়টি তাদের জন্য খুব সেনসেটিভ। বাংলাদেশ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০১-১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৮৬ জন শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ৯৯ ভাগ শিশু ধর্ষণের শিকার। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর একটি জরিপে দেখা যায়, গত চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) দেশে শুধু ধর্ষণের ঘটনা-ই ঘটেছে ১৫৮টি। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৯৩ ও নারীর সংখ্যা ৬১ জন। বাকি ৪ জনের বয়স নির্ধারণ করা যায়নি। ৬৭ টি শিশু সংগঠনের মোর্চা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী গত তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) সারাদেশে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, রাজনৈতিক সহিংসতা, গ্রেপ্তার, আত্মহত্যা, স্কুলে শারীরিক নির্যাতন, শিশুবিবাহসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে ১ হাজার ২৯৯ জন শিশু।  WHO এর হিসেব মতে, প্রতি বছর ৪০ মিলিয়ন শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
বিলিভ ইট অর নট আপনার চোখের সামনেই আপনার শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছে কিন্তু আপনি টের পাচ্ছেন না। জামাই-বউ খেলা, কানামাছি খেলা, সিক্রেট ব্যাপার বলে নোংরামি করা, ভয় দেখানো, বাজে উদ্দেশ্যে আদর বা ভালোবাসার কথা বলাসহ ভদ্রতার লেবাসে চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ করা হচ্ছে অতি সতর্কতার সঙ্গে নানা উপায়ে। এইক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে আপনার সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।  সেই সাথে আপনার শিশুর সবচেয়ে ভালো বন্ধু হোন। যেনো সে তার সব কথা আপনার সাথে নিঃসঙ্কোচে শেয়ার করতে পারে। আপনার শিশু কাদের সাথে মিশে সে সর্ম্পকে সজাগ থাকুন। যৌন নিপীড়ককে আপনার শিশু চিনতে না পারলেও একটু ভালোভাবে খেয়াল করলে আপনি ঠিক-ই চিনতে পারবেন। সে যত-ই আপনার কাছের কেউ হোক না কেনো তার কাছ থেকে আপনার শিশুকে নিরাপদ দুরত্বে রাখুন। আপনার শিশুকে বুঝান- কোনটি ‘ভালো আদর’ আর কোনটি ‘মন্দ আদর’। কোন ধরণের মানুষ থেকে দূরে থাকতে হবে অর্থাৎ কাদের সঙ্গে কখনো মেশা যাবে না সে বিষয়ে আপনার শিশুকে অবগত করুন। তার শরীরের গোপন জায়গাগুলো সম্পর্কে তাকে সতর্ক করুন। আপনার সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতা অনেকাংশে আপনার শিশুকে সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ থেকে রক্ষা করবে নিঃস্বন্দেহে। চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ বা শিশু যৌন নির্যাতন যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হারে প্রতি রোধমূলক ব্যবস্তা নেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার ও ডেনমার্ক সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টারাল প্রোগ্রামের আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ২০১২ সালে। দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে যেকোন সময় ১০৯২১ নম্বরে বিনামূল্যে ফোন করে সাহায্য পেতে পারেন নির্যাতনের শিকার যেকোন নারী ও শিশু। কিন্তু বাজেট ও জনবলের স্বল্পতা এবং প্রদত্ত শিশু সেবা সর্ম্পকে প্রচারের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে এক্ষেত্রে কাঙ্খিত লক্ষ অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরেও চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের ক্ষেত্রে এইসব উদ্যোগের চেয়েও বেশি কার্যকরী হচ্ছে সচেতনতা সৃষ্টি।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে আমরাও এর জন্য দায়ী। যেমন- শিশুর সামনে তাদের অনুপযোগী চলচিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপন বা মিউজক ভিডিও দেখা, অশালীন কথা-বার্তা বলা, তাদেরকে বাসায় একা রেখে বাইরে যাওয়া অথবা তাদেরকে বাইরে একা যেতে দেয়া, যার-তার সাথে মেশতে দেয়া, তাদেরকে একদম গুরুত্ব না দেয়াসহ নানাভাবে। কাজেই সময় থাকতে এসব ব্যাপারে দায়িত্বশীল না হলে পরবর্তী সময়ে অপূরণীয় ক্ষতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শিশুদের সুন্দরভাবে বেড়ে উঠার জন্য একটি সুন্দর পৃথিবীর প্রয়োজন অনেক বেশি। তাদেরকে তেমন একটি পৃথিবী উপহার দেয়ার দায়িত্ব আমার, আপনার, সকলের। আসুন নিজে সচেতন হই এবং সচেতনতার সৃষ্টি করি, আর একটি শিশুও যেনো  সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার না হয়।
লেখক: সংগঠক, কলামিষ্ট ও গল্পকার
mabakibillah@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.