জামায়াতে ‘সংস্কারপন্থীদের’ ভাবনা

পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন পলিটিক্যাল ইসলাম। সারা দুনিয়াতেই এখন চাপের মুখে এ আন্দোলন। বিশ্ব আর বাংলাদেশে প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামীর ‘সংস্কারপন্থীদের’ এক বৈঠকে এ নিয়ে একটি কী নোট পেপার উত্থাপন করা হয়েছিল। মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক সম্পাদিত ‘কামারুজ্জামানের চিঠি এবং জামায়াতের সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক গ্রন্থে ওই কী নোট পেপারটি মুদ্রিত হয়েছে। এর প্রথম পর্বে রয়েছে-
রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনার ইতিহাস সুদীর্ঘ হলেও রাজনৈতিক দলের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। মাত্র অষ্টাদশ শতকে ইউরোপ ও আমেরিকায় রাজনৈতিক দল গঠনের সূচনা হয়। সপ্তদশ শতকে বৃটেনে হুইগ ও টোরি পার্টি জন্ম হলেও সেগুলোর তেমন প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব ছিল না। বৃটেনের বড় বড় ভূস্বামী ও ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে যে গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিল তারাই পার্লামেন্টে হুইগ ও টোরি পার্টি হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এ সময় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও তেমন বিকশিত হয়নি। ভোটাধিকার সীমিত ছিল উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবার সাথে সাথে রাজনৈতিক দলগুলোও ক্রমান্বয়ে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে উঠতে থাকে। স্যার রবার্ট ফিলের নেতৃত্বে বৃটেনে ১৮৩০ সালে প্রথম কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় আসে। পুরো অষ্টাদশ শতক জুড়ে কনজারভেটিভ পার্টি ও লিবারেল পার্টির মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলে। ১৯২০ সালের দিকে লিবারেল পার্টি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়লে লেবার পার্টির বিকাশ ঘটে।
আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন রাজনৈতিক দল গঠনের বিরোধী ছিলেন। সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্ক দেখা দেয়। এর ফলশ্রুতিতে দু’টো রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়: (১) উত্তরাঞ্চলের নেতা হ্যামিলটনের নেতৃত্বে ফেডারেলিস্ট পার্টি, এরা শক্তিশালী ফেডারেল/কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষপাতি এবং আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রে বৃটেনের সমর্থক। (২) দক্ষিণাঞ্চলের নেতা জেফারসনের নেতৃত্বে গঠিত হয় রিপাবলিকান পার্টি। এরা দুর্বল ফেডারেল/কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষপাতি এবং আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রে ফ্রান্সের সমর্থক।
এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যুদয় ঘটে প্রধানত উপনিবেশিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সংঘবদ্ধ শক্তি হিসেবে। এদের অধিকাংশ নেতাই আবার পাশ্চাত্য দর্শনে শিক্ষিত ছিল; তবে তারা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনাকে কাজে লাগান। অবশ্য কোনো কোনো দেশে ইসলামী আদর্শকে ধারণ করেই শুরু থেকে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন। লক্ষণীয় যে, প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ইসলামী আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। কিন্তু এ সকল দলের রাজনৈতিক শক্তি অর্জনে যথেষ্ট সময় লেগেছে এবং তাদেরকে বহু কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। স্বৈরশাসক ও সামরিক শাসকদের আমলে ইসলামী দলগুলো বহু নির্যাতন ও নিষিদ্ধ হওয়ার শিকার হয়।
সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দেশের নির্বাচনী ফলাফল
২০০৮ সালের প্রথমার্ধে পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ার সংসদ নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো হতাশাব্যঞ্জক ভোট পেলে একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেন যে, এশিয়ার কোনো মুসলিম দেশে নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে ইসলামী এজেন্ডাকে গোপন রাখতে হবে। মালিয়েশিয়ায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের মার্চ মাসে। এতে ইসলামী দল ‘পার্টি ইসলাম-সে-মালয়েশিয়া’ (পাস)’র আসন সংখ্যা ৬ থেকে ২৩টিতে বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে ক্ষমতাসীন মহাজোটের আসন সংখ্যা বেশ কমে যায়। ১৯৬৯ সালের পর দলটির এরূপ বিপর্যয় আর ঘটেনি। মহাজোট নেতা প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ বাদাওয়ী নির্বাচনী প্রচারণায় ইসলামী উম্মাহর ঐক্যের আহ্বান জানান। পক্ষান্তরে পাস নেতারা অতীতের মতো ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার সেøাগান না দিয়ে ‘স্বচ্ছ সরকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করেন। পাস নেতৃবৃন্দ আরো একধাপ এগিয়ে প্রথমবারের মতো নারীদের হিযাব বাধ্যতামূলক করার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন এবং দলটি প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অমুসলিম ও নারীদের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে পাশ্চাত্য বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন যে, এ নির্বাচনে পারভেজ মোশাররফের ভরাডুবি হলেও প্রকৃতপক্ষে ভরাডুবি হয়েছে ইসলামপন্থীদের। তাদের মতে, আল-কায়েদা ও তালেবানদের সাথে সম্পর্কযুক্ত ইসলামী দলগুলো ইতোপূর্বের নির্বাচনে যেখানে ১১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, এবারের নির্বাচনে তা কমে গিয়ে ৩ শতাংশে নেমে আসে। এর আগে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশে ইসলামী জোটের সরকার ছিল। ২০০৮ এর নির্বাচনে সেটি দখল করে নেয় সেক্যুলার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। ২০০১ সালে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে যেখানে ইসলামী দলগুলোর আসন সংখ্যা ছিল ২০টির উপরে এবং জোট সরকারে তাদের ২ জন মন্ত্রীও ছিল। ২০০৮ এর নির্বাচনে পার্লামেন্টে তাদের আসন সংখ্যা নেমে আসে মাত্র ২টিতে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনো মুসলিম দেশেই পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো সরকার গঠনের মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন লাভ করতে পারেনি। বরং দেখা যায়, তাদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। মালয়েশিয়ায় সংসদ নির্বাচন ইসলামী দলগুলো কখনোই ১১ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। একইভাবে ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামী দলগুলো সবাই মিলে কখনোই ১৭ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলো নব্বই দশকে ১১-১২ শতাংশ ভোট পেলেও সাম্প্রতিককালে তা ৩-৪ শতাংশে নেমে এসেছে। আফগানিস্তানে তালেবান সমর্থকরা মাত্র ১১ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অবশ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত এ নির্বাচন কতটা অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল, সে প্রশ্ন রয়েছে।
কয়েক বছর আগে পাশ্চাত্য বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছিলেন, ইরানে সরকার মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে তেমন আগ্রহী হয় না। যেমন, নব্বই দশকের শেষদিকে নির্বাচনে মাত্র ৪৬ শতাংশ ভোটার ভোট দেয় এবং এতে শহুরে ভোটার ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ। তেহরানে এই হার ছিল মাত্র ১৯ শতাংশ। কিন্তু সাম্প্রতিককালে ইরানে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও তার ফলাফল নিয়ে বিদেশী ষড়যন্ত্র এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার জন্ম দেয় যা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। এবারের নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ৮৫ শতাংশের বেশি হওয়া এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, ইরানের নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আর একটাও ইঙ্গিত দেয় যে, মুসলিম দেশগুলোতে ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র ও মিডিয়ার প্রচারণা ভোটারদের বিভ্রান্ত করার জন্য সচেষ্ট থাকবে। আশার কথা যে, ইরানে অনুষ্ঠিত এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে পাশ্চাত্য যে নোংরা খেলা খেলেছে তা বুমেরাং হয়েছে এবং আহমেদী নেজাদ ও ইরানের ইসলামী সরকারের প্রতি মুসমিল দেশগুলোর সমর্থনকে দৃঢ়তর করেছে।
২০০৮ সালের নভেম্বরে জর্ডানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইসলামিক এ্যাকশন ফ্রন্ট-এর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা চার বছর আগের ১৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৫ শতাংশে নেমে আসে। তারা পূর্বেকার ১৭টি আসনের স্থলে মাত্র ৬টি আসন পায়। প্যালেস্টাইনের গাজায় হামাসের জনপ্রিয়তা একবারে তুঙ্গে। এতদসত্বেও তারা ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট পেয়েছে ৪৬ শতাংশ। তুরস্কে ইসলামপন্থী একে পার্টি ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট পেয়েছে স্মরণকালের সর্বোচ্চ ৪৪ শতাংশ। অবশ্য তারা নির্বাচনী প্রচারণায় ইসলামী রাষ্ট্রের কথা না বলে সংবিধানে বর্ণিত সেক্যুলার নীতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। তুরস্কের দেখাদেখি মরক্কোতে গঠিত হয় পার্টি অব জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট। তারা তুরস্কের একে পার্টির বিশেষজ্ঞ পরামর্শও গ্রহণ করে। এতদসত্বেও দলটি নির্বাচনে মাত্র ১০ শতাংশ ভোট পায়।
আলজেরিয়ায় দু’টি ইসলামী দল ২০০৭ -এ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট পেয়েছে মাত্র ১২ ভাগ। ইয়েমেনে গত ২০ বছর ধরে নির্বাচন হচ্ছে। সেখানকার ইসলামী দলগুলো সর্বোচ্চ ২৫ ভাগ ভোট পায়। ২০০৩ সালের নির্বাচনে তা আবার ২২ ভাগে নেমে আসে।
কুয়েতে মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেখানকার ইসলামী দলগুলো সর্বোচ্চ ২৭ ভাগ ভোট এবং ৫০ আসনের পার্লমেন্টে ১৭টি আসন পায়। লেবাননে ২০০৫ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দু’টি ইসলামী দল সম্মিলিতভাবে ২১ ভাগ ভোট এবং ৯২ আসনের পার্লামেন্টে ২৮টি আসন পায়। সম্প্রতি লেবাননে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচন ও তার ফলাফল নিয়ে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র ও মিডিয়ার প্রচারণা বেশ লক্ষ্যণীয়। আশা করা গিয়েছিল যে, হেজবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন জোট জয়লাভ করবে। কিন্তু মার্কিনপন্থী সেক্যুলার জোটের জয়লাভ হতাশার জন্ম দিয়েছে। তবে এটাও শিক্ষণীয় যে, পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র ও দেশীয় দালালদের কারণে নির্বাচন কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না।
উল্লেখিত, তথ্যগুলো থেকে প্রতীয়মান হয়, কোনো মুসলিম দেশেই ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠনের মতো ভালো ফল লাভ করতে পারছে না। এর কারণ গবেষণা ও অনুসন্ধানের দাবি রাখে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের মন্তব্য: ‘অধিকাংশ মুসলমান সেক্যুলার রাষ্ট্র কাঠামোতে ইসলামী সমাজে বাস করতে চায়।’

No comments

Powered by Blogger.