যে ছবিতে কাঁদছে বিশ্ব

তুরস্কের পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্র সৈকতে শিশু আইলানের লাশ;
জীবদ্দশায় খেলারত আইলান ; শিশু আইলানের
লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে : এফপি
তুরস্কের পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্রসৈকতে উদ্ধার হওয়া সিরীয় উদ্বাস্তু শিশুটির লাশের হৃদয়বিদারক ছবিটিই যেন এখন উদ্বাস্তুদের জীবনের ভয়াবহতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আদরের ছোট দুই সন্তান আইলান ও গালিব এবং স্ত্রীকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন আবদুল্লাহ কুর্দি।
সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের গৃহযুদ্ধ থেকে জীবন বাঁচাতে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ইউরোপ অভিমুখে রওনা দেন আবদুল্লাহ কুর্দি। নৌকায় করে তুরস্কের বোদরাম উপদ্বীপ থেকে গ্রিসের এজিয়ান দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হন তারা। এরপর সেখান থেকে যাবেন কানাডায়। সেখানে শুরু হবে তাদের নতুন জীবন। কিন্তু নতুন জীবনের পরিবর্তে সাগর কেড়ে নিলো তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের জীবন। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত মধ্যপ্রাচ্যের এ মানুষটির কাছে শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ বিভীষিকায় পরিণত হলো। এখন এই দুঃসহ স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে আছেন আবদুল্লাহ কুর্দি। সব কিছু হারিয়ে বেঁচে আছেন তিনি একা। উত্তাল ঢেউয়ের তোড়ে শিশুরা বাবা-মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ল সমুদ্রে। ভাসিয়ে নিয়ে এলো এক শিশুর লাশ তুরস্কের সমুদ্র এক সৈকতে, আর মায়ের লাশ দূরের অন্য এক সৈকতে।
ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যায় ওরা : বাবা আবদুল্লাহ
গত বৃহস্পতিবার তুরস্কের বোদরামের নিকটবর্তী মুগলা শহরের একটি মর্গ থেকে বেরিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আবদুল্লাহ। সাগরে নৌকাডুবির পর সৈকতে ভেসে এসেছিল তার তিন বছরের সন্তান আইলানের লাশ। পরে এক পুলিশ শিশুটির লাশ কোলে তুলে নেন। মর্গ থেকে বেরিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আবদুল্লাহ বলেন, ‘এখন আমি আর কিছুই চাই না। এখন যদি আপনারা আমাকে বিশ্বের সব দেশ দিয়ে দেন তবুও আমার আর কিছুই চাই না। আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলোই আমি হারিয়ে ফেলেছি।’ তার একটাই চাওয়া স্ত্রী-সন্তানের লাশ তিনি সিরিয়ার কোবানিতে নিয়ে যেতে চান। তার আর ইউরোপে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। তিনি বলেন ‘আমি শুধু শেষবারের মতো আমার সন্তানদের দেখতে চাই এবং চিরদিন তাদের সাথেই থাকতে চাই’।
আবদুল্লাহ বলেন, তীব্র স্রোতের কবলে পড়ে প্রথম সন্তান মারা যায়, অন্যদের বাঁচাতে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এরপর আলো অনুসরণ করে সাঁতারে তীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। হাসপাতালে গভীর শোকে বিহ্বল আবদুল্লাহ বলেন, জীবন বাঁচাতে নৌকা ধরে রাখার প্রাণপন চেষ্টা করি; কিন্তু এটি দুলছিল। প্রবল ঢেউ, বৈরী আবহাওয়া আর অন্ধকারে বিভীষিকাময় এক পরিবেশ। কিছুণ পর স্ত্রী-সন্তান কারো আওয়াজ আর শুনতে পাচ্ছিলাম না। যাদের জন্য সব কিছু তাদের হারিয়ে নিঃস্ব আবদুল্লাহর এখন আর কিছুরই প্রয়োজন নেই। পুরো বিশ্ব হাতের মুঠোয় এনে দিলেও তা অসীম বেদনার শেষ হবে না।
আবদুল্লাহ বলেন, কানাডা আশ্রয়ের জন্য আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। তবে এ ‘ছবিটি’ (সমুদ্রের পাড়ে সন্তানের ছবি) আমাকে সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে। আশ্রয়ের আশায় এটি তাদের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা জানিয়ে আবদুল্লাহ আরো বলেন, এ জন্য চোরাকারবারিদের চার হাজার ইউরো দিয়েছিলেন। অথচ চোরাকারবারিরা তাদেরকে রেখে পালিয়ে যায়।
স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিবারসহ গ্রিসে যাওয়ার জন্য দুইবার আবদুল্লাহ দালালদের টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে একটি নৌকায় যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি ও আরো কয়েকটি পরিবার। যাত্রা শুরুর পরপর নৌকায় পানি উঠতে শুরু করলে লোকজন আতঙ্কে উঠে দাঁড়ানোর পর সেটি ডুবে যায়।
আবদুল্লাহ কুর্দি পুলিশকে জানিয়েছেন, তার হাত থেকে শিশুরা ফসকে যাওয়ার পর তিনি তন্নতন্ন করে তাদের খুঁজেছেন। তারা প্রায় ৩ ঘণ্টা পানির মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করেছেন। এরপর হয়তো ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তাই আর কথা বলতে পারছেন না বলে মা চাইলেন। তবে কথা শেষ করার আগে কিছু বার্তা দিলেন তিনি, ‘আমি সত্যিই চাই পাচার বন্ধ হোক। যারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছেন তাদের জন্য একটি সমাধানের পথ খোলা হোক।’
আবদুল্লাহর বোন তিমা কুর্দিকে উদ্ধৃত করে কানাডার ন্যাশনাল পোস্ট পত্রিকা জানিয়েছে, ‘আমি তাদের স্পন্সরের চেষ্টা করেছিলাম। আমার বন্ধু ও প্রতিবেশীরা ব্যাংক ডিপোজিট দিয়ে আমাকে সহায়তা করেছিল। কিন্তু আমরা তাদের আনতে পারিনি এবং সে কারণে তারা ওই নৌকায় গিয়েছিল। তুরস্কে তাদের থাকার জন্যও আমি টাকা পাঠাচ্ছিলাম। কিন্তু সেখানে তারা সিরীয়দের সাথে যে আচরণ করে তা ভয়াবহ।’
আবদুল্লাহ ও তার পরিবারের সাথে নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ওমাইর মহসিন নামে আরেক সিরীয় বলেন, রাত ২টায় যাত্রা করার কিছুণ পর নৌকাটি ডুবে গেলে সাঁতরে তীরে আসেন তিনি। কিন্তু তার ভাই এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘নৌকায় বড়জোর ১০ জনকে উঠানো যেত। কিন্তু তারা ১৭ জনকে উঠিয়েছিল। আমি ও আমার ভাই প্রত্যেকে দুই হাজার ৫০ ইউরো করে দিয়েছিলাম।’
একটি ভিডিওচিত্রে সৈকতে বালুতে আরেকটি শিশুর লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ওই লাশটি আইলানের ভাই গালিবের হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সৈকতে আইলানের লাশের ছবি তুলেছেন দোয়ান বার্তা সংস্থার ফটোসাংবাদিক নিলুফার দেমির। তিনি সিএনএনকে জানিয়েছেন, ‘যখন দেখলাম শিশুটিকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই তখন ভাবলাম তার ছবি তোলা উচিত, যাতে মর্মান্তিক এই ঘটনা দেখানো যায়। এখন এই ছবিটি যে প্রভাব ফেলেছে তা অভিবাসী সমস্যা নিরসনে সহায়তা করবে বলে আমি আশা করছি।’
সমবেদনা-ক্ষোভ-নিন্দা
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ছবিটি প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাশাপাশি এই ছবির সংবাদমাধ্যমের খবরের নিচে মন্তব্য করে নিজেদের শোক-সমবেদনার কথা জানান পাঠকেরা। একইসাথে তারা যুদ্ধবাজ সিরিয়া ও ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের কঠোর নিন্দা করছেন। নিন্দা জানাচ্ছেন প্রাণ বাঁচাতে ছুটে আসা উদ্বাস্তুদের ঠেকানোর পরিকল্পনাকারী ইউরোপের নেতাদেরও।
আপে নিয়ে তিনি সংবাদিকদের বলেন, নিজের দেশের যুদ্ধ থেকে বাঁচতে আমরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেখানে আমাদের যা ঘটল তা সারা বিশ্ব দেখুক। শান্তিপূর্ণ জীবনের আশায় পরিবার নিয়ে ইউরোপ অভিমুখে রওনা হয়ে নির্মম ঘটনার শিকার আবদুল্লাহ মনে করেন, সন্তানের এ ছবি পুরো বিশ্বকে বদলে দেবে। এটিই যেন এ ধরনের সর্বশেষ ঘটনা হয়Ñ এই তার প্রত্যাশা।
সিরিয়ার কুবানি শহরেই চিরনিদ্রায় শিশু আইলান
বিবিসি জানায়, তুরস্কের উপকূলে নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া তিন বছরের শিশু আইলানকে সিরিয়ার কুবানি শহরে দাফন করা হয়েছে। তার কবরের পাশেই দাফন করা হয়েছে পাঁচ বছরের ভাই গালিপ এবং মা রেহানকে (৩৫)। এ সময় বাবা আবদুল্লাহ কুর্দির অঝোর কান্নায় ভিজেছে কুবানির শুষ্ক ও লালমাটি।
দাফন অনুষ্ঠানে বহু মানুষ অংশ নেন। বাবা আবদুল্লাহর ইচ্ছাতে তাদের নিজ মাতৃভূমি সিরিয়াতে ফিরিয়ে আনা হয়। আব্দুল্লাহ তার দুই ছেলে ও স্ত্রীর লাশ মাতৃভূমি সিরিয়ার কুবানি শহরেই দাফন করতে চেয়েছিলেন। তুরস্ক থেকে পুলিশ পাহারায় তাদের কফিন সিরিয়া আনা হয়। এ সময় তুরস্কের কয়েকজন এমপিও কফিনের সাথে ছিলেন। লাশ গ্রহণের সময় সময় কুর্দি জনগণ সিরিয়া পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য আরব দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তারা বলেন, ইউরোপ নয় বরং আরব দেশগুলোকেই ভূমিকা নিতে হবে। আরব দেশগুলো মদদ দেয়া বন্ধ করলে সিরিয়া সমস্যার সমাধান হবে।

No comments

Powered by Blogger.