নেপালের অভিজ্ঞতা, আমাদের বাস্তবতা by মো. মাহবুব জাহান খান

ঘটনা অনেকগুলোই বলতে হবে, তবে একটি দুর্ঘটনা দিয়েই শুরু করি। ৪ মার্চ ২০১৫-এর শীতের কুয়াশাঘন সকাল সাতটা বেজে পনেরো মিনিট। কাঠমান্ডুর একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণের চেষ্টা করছে ‘টার্কিশ এয়ারলাইনস’-এর ফ্লাইট টিকে ৭২৬। মোট ২২৪ জন যাত্রী নিয়ে এয়ারবাস ৩৩০ প্রথমবার অবতরণে ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে পিচ্ছিল রানওয়েতে অবতরণের পরপরই বিমানের সামনের চাকা ভেঙে গিয়ে বিমানটি রানওয়ের ডান পাশে নরম ভেজা ঘাসের মাটিতে আটকে যায়। পৃথিবীর যেকোনো উন্নত দেশে এ ঘটনা ঘটলে গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু নেপালের ক্ষেত্রে তা হলো না। উদ্ধার সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতার কারণে চার দিনের জন্য রানওয়ে বন্ধ রাখতে হলো।
কথায় আছে নেপালের মানুষ কখনো কখনো রসিকতা করে বলে থাকে, ‘আমরা আগুন দেখার পর পানির জন্য কূপ খনন শুরু করি’। চার দিন বিমান ওঠা–নামা বন্ধ থাকায় প্রায় ৮০ হাজার যাত্রী বিভিন্ন স্থানে আটকে থাকেন। ভারত থেকে সে দেশের বিমানবাহিনীর সি-১৩০জে হারকিউলিস বিমান (যা ছোট রানওয়েতে ওঠা–নামা করতে পারে) প্রয়োজনীয় উদ্ধার সরঞ্জাম ও জনবল এনে উদ্ধারকাজ সম্পন্ন করে। এর পরের মাসের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনা আমাদের সবারই জানা। আমরা অনেকে হয়তো এটা জানি না যে সেই একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এখন আর বড় রিলিফ বিমান ওঠা–নামা করতে পারছে না এবং যে জন্য দুর্যোগ-পরবর্তী রিলিফ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সাহায্য বা বিমানের অভাব হচ্ছে না, অভাব হচ্ছে শুধু রানওয়েতে অবতরণের সুযোগ পাওয়ার। বিকল্প একটি যথাযোগ্য রানওয়ে থাকলে নেপালের উদ্ধারকাজ ও পুনর্বাসনকাজে আরও অনেক গতি আসত, এটা বলা যায় নিঃসন্দেহ। দু-চারটা ঘটনার উল্লেখ করলে বোঝা যাবে একাধিক রানওয়ে কিংবা বিকল্প বিমানবন্দর থাকার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু।
ভূমিকম্পের ঘটনার পর ২৭ এপ্রিল রিপাবলিক অব সিঙ্গাপুর বিমানবাহিনীর তিনটি সি-১৩০ বিমান প্রচুর ত্রাণসামগ্রী, চারটি কুকুরসহ উদ্ধারকারী দল অবতরণের সুযোগ না পেয়ে দুটি ভারতের কলকাতায় ও একটি পাটনায় অবতরণ করতে বাধ্য হয়। একই দিন থাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট (টিজি-৩১৯) সকালে উদ্ধারকর্মী ও সাংবাদিকসহ নেপালের উদ্দেশে থাইল্যান্ড ছাড়ে। কিন্তু সেখানে অবতরণের সুযোগ না পেয়ে কলকাতা এসে জ্বালানি নিয়ে পুনরায় নেপালে যায় এবং এবারও অবতরণের সুযোগ না পেয়ে কলকাতায় ফিরে আসে। কিন্তু কলকাতার সব হোটেল পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় বিমানটি পরদিন রাত আটটায় আবার থাইল্যান্ডেই ফিরে যায়। ২৯ এপ্রিল অস্ট্রেলীয় ডিফেন্স ফোর্সের দুটি সি-১৭ গ্লোবমাস্টার বিমান প্রচুর তাঁবু, মেডিকেল টিম ইত্যাদি নিয়ে নেপালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয় কিন্তু অবতরণের অনুমতি না পেয়ে সেটিকেও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়।
একই রকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল নেপালে বাংলাদেশের রিলিফ মিশন নিয়ে। ত্রাণসামগ্রী বিমানে ওঠানো আছে, বিমান এবং বৈমানিকসহ অন্যান্য ক্রু প্রস্তুত আছে, তবে নেই শুধু কাঠমান্ডুতে অবতরণের একটু সুযোগ। ফলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সি-১৩০ বিমান দিয়ে যে ছয়টি মিশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে তার মধ্যে তিনটিরই সময় পরিবর্তন করতে হয়েছিল। এ ছাড়া প্রচুর বিমান ওঠা–নামার কারণে রানওয়ের অবস্থা বেশ কিছুটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় কানাডার তিনটি এবং যুক্তরাষ্ট্রের চারটি সামরিক বিমানকে নেপালে অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এমন ঘটনা আরও অনেক ঘটেছে, তবে সর্বশেষ আমরা দেখলাম, ৩ মে ২০১৫ থেকে কোনো ধরনের বড় বিমানকে কাঠমান্ডুতে ওঠা–নামার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না এবং সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব নেপাল (সিএএএন) সব দেশকেই জানিয়ে দিয়েছে যে ১৯৬ টনের অধিক ওজনের বিমান নিয়ে ত্রাণসামগ্রী না পাঠাতে। নেপালের জন্য এ বাস্তবতা খুবই কঠিন এবং খুবই হতাশাব্যঞ্জক। এতে বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ কিংবা জনবলের মাত্রা কমে যাচ্ছে, যা উদ্ধার ও পুনর্বাসনকাজকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।
এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে এই মাত্রার ভূমিকম্প হলে পরিস্থিতি কী দঁাড়াবে তা অনুমান করাও কঠিন। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির দেশ আমাদের এই বাংলাদেশের নির্মাণকৌশল, নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান, ভবনগুলোর বয়স, অপ্রশস্ত রাস্তা—ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। সে মহাঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি আমাদের নিতেই হবে।
নেপালের বিমানবন্দরে রানওয়ের অপ্রতুলতা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, রানওয়ে দিয়েই এটি শেষ করতে চাই। রানওয়ে বিবেচনায় বাংলাদেশ নেপালের চেয়ে বর্তমানে বেশ ভালো অবস্থানে আছে। আমাদের কমপক্ষে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আছে, যেগুলোর ক্ষমতাও বেশ ভালো। কিন্তু নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি সামনে কেটে যাবে। কারণ, সেখানে চীন সরকারের অর্থায়নে ভারত নেপাল সীমান্তের কাছে ভাইরাহাওয়া নামক স্থানে আরও একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণাধীন। ভারত-নেপাল সীমান্তের নিজগাধ নামক স্থানে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অনুমোদনের অপেক্ষায় এবং রিসোর্ট শহর পোখারায় আরও একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মিত হবে।
ঢাকার একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি যদি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা কী? চট্টগ্রাম বা সিলেট বিমানবন্দরকে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই দুটি বিমানবন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়? তা ছাড়া চট্টগ্রাম বা সিলেটে ত্রাণসামগ্রী বা উদ্ধারকারী দল নামলে তা ঢাকায় পৌঁছাবে কেমন করে? এত দীর্ঘ সড়কের কোথাও যে বড় ফাটল হবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে? সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও ত্রাণসামগ্রী বা উদ্ধারকারী দল পৌঁছাতে যে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হবে, তাতে ক্ষয়ক্ষতি শুধু বেড়েই চলবে।
ঢাকার দ্বিতীয় বিমানবন্দর, যেটি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আছে সেটি অর্থাৎ তেজগাঁও বিমানবন্দরকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করলে তা উত্তম বিকল্প হিসেবে এ ধরনের দুর্যোগে কাজে লাগানো যাবে। উল্লেখ্য, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যা, ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর ও অন্যান্য দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জন্য ত্রাণ কার্যক্রম তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকেই অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত হয়। কাজেই দুর্যোগ ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্র হিসেবে এ বিমানবন্দরটিকে তার অবস্থানগত সুবিধার কারণে ব্যবহার করা যথাযথ হবে। এমনিতেও তেজগাঁও বিমানবন্দরকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ‘জরুরি বিকল্প’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে আট হাজার ফুট দীর্ঘ ও ১৫০ ফুট প্রশস্ত সুবিশাল রানওয়ে রয়েছে। মাঝারি ক্যাটাগরির বিমান যেমন: সি-১৩০, এন-৩২, এফ-২৮, বোয়িং-৭৩৭ ইত্যাদি এখানে সহজেই ওঠা–নামা করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে পার্কিংয়ের জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে, যেখানে ছোট-বড় ২০-২৫টি বিমানকে দুর্যোগকালে পার্কিং করা যাবে।
আশার কথা, সম্প্রতি (২৭-০৫-২০১৫) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবাহিনীর এল-৪১০ পরিবহন প্রশিক্ষণ বিমানের অন্তর্ভুক্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এল-৪১০ বিমানগুলো বর্তমানে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকেই পরিচালিত হচ্ছে। হয়তোবা অচিরেই এ বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয় মেরামত ও সংস্কারকাজও হাতে নেওয়া হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ভূমিকম্পজনিত কোনো দুর্যোগে এ বিমানবন্দরের আশপাশের খোলা এলাকা দুর্যোগকবলিত মানুষের জন্য প্রয়োজনে তাঁবু খাটানোর জন্যও ব্যবহার করা যাবে। ঢাকা শহরের যতটুকু জায়গা খোলা আছে, তা বড় ধরনের ভূমিকম্পে তাঁবু খাটানোর জন্য যে খুবই অপ্রতুল সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে রাখতে হবে যে প্রচুর খোলা জায়গা দরকার হবে বিদেশ থেকে আসা ত্রাণসামগ্রী রাখার জন্য, উদ্ধারকর্মী ও উদ্ধার সরঞ্জাম রাখার জন্য, ফিল্ড হাসপাতাল চালু করার জন্য এবং জরুরি অন্যান্য কাজে। কাজেই আমাদের উচিত হবে সরকারি সব খোলা জায়গা যেমন: পার্ক, খেলার মাঠ ইত্যাদি যথাযথ সংরক্ষণ করা এবং নতুন খোলা জায়গা সৃষ্টি করা।
বিমানবন্দরের কথা বলছিলাম। ঢাকার অদূরবর্তী আড়াইহাজার (নারায়ণগঞ্জ), সরারচর, কুলিয়ারচর (কিশোরগঞ্জ), কুমিল্লা এবং টাঙ্গাইলে বিদ্যমান এয়ার স্ট্রিপ বা রানওয়েগুলো কিছুটা সংস্কার করে জরুরি রিলিফ অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে। আমাদের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ একটি দেশে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে বিদ্যমান বিমানবন্দরটিকে অর্থাৎ তেজগাঁও বিমানবন্দরটিকে অবশ্যই এ ধরনের যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যবহার করার প্রয়োজনে সংরক্ষণ করা অতি জরুরি এবং সেটিই হবে আমাদের সবার প্রত্যাশা।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. মাহবুব জাহান খান, বিপিপি, পিএসসি: ভূমিকম্প–পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আইবিএ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল প্রোগ্রামে গবেষণারত।

No comments

Powered by Blogger.