ইতিহাসের আয়নায় দেখা মুখ by সাজেদুল হক

প্রশ্নটি দ্য ইকোনমিস্টের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ।
আচ্ছা ইতিহাস কিভাবে মনে রাখবে এই মানুষটিকে। যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়ে আসার কৃতিত্ব তাকে দেয়া হবে; নাকি ইতিহাস বলবে, তার সময়ে বিশ্বব্যাপী মার্কিন কর্তৃত্ব ক্রমশ শিথিল হয়েছে।
বাংলাদেশে ইতিহাস সবসময়ই অন্যতম আলোচ্য বিষয়। মাঝে এ আলোচনা কিছুটা কমে এসেছিল। রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষের ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া এর অন্যতম প্রধান কারণ। তবে নাটকীয়ভাবে ইতিহাস আবার ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। যদিও এ দেশের রাজনীতিবিদরা ইতিহাসের আয়নায় তাদের মুখ দেখার চেষ্টা করেন কি-না তা বলা মুশকিল। ঠাট্টার ছলে এক রাজনীতিবিদ একবার বলেছিলেন, আমার বাসায় একটা লম্বা আয়না আছে। আমি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়নায় নিজের চেহারা দেখি। কবি হেলাল হাফিজ অবশ্য লিখেছেন- একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম শুধু আমাকেই দেখা যায়। আলোর প্রতিফলন প্রতিসরণের নিয়ম না জানা আমি সেই থেকে আর কোন দিন আয়না দেখি না।
হয়তোবা এ কারণেই ইতিহাসের আয়নার সামনে দাঁড়াতে আমাদের যাবতীয় অনীহা। তবুও শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আয়নার সামনে আমাদের দাঁড়াতেই হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাসদ একটি অমীমাংসিত অধ্যায়। ইতিহাসের এক উজ্জ্বল প্রজন্ম জাসদের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। চোখে তাদের বিপ্লবের স্বপ্ন। সে স্বপ্ন ব্যর্থ হয়। কেন সেই ব্যর্থতা সে আলোচনা অবশ্য ভিন্ন। সত্য গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর- মার্ক টোয়েনের সেই বিখ্যাত উক্তি জাসদের রাজনীতির ক্ষেত্রে হয়তো সবচেয়ে বড় এক সত্য। সেই জাসদ নিয়ে আবার তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। এবার শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের প্রভাবশালী সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। বলেছেন, জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিল। একই মত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের। তবে জাসদ সভাপতি, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, কুচক্রীমহল জাসদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
তবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জাসদের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে বছর খানেক আগে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের লেখা- ‘জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বইটি প্রকাশিত হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। জাসদ এখন ক্ষমতাসীন সরকারের অংশীদার বলেই হয়তো এ বিতর্ক এতটা প্রবল। ওই বইতে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন,  সন্ধ্যায় খোন্দকার মোশ্তাক আহমদ বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তাহের উপস্থিত ছিলেন। দু’দিন পর ১৭ই আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ করতে। ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া।
তবে জাসদের পক্ষ থেকে বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। শেখ সেলিম তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে ১৫ই আগস্টের দিনে যথাযথ ভূমিকা পালন না করার জন্য তৎকালীন সেনা প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহকে অভিযুক্ত করেছেন। তিনি মনে করেন সেনা প্রধান সেদিন যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি। উল্টোদিকে, কে এম সফিউল্লাহ অভিযোগ করেছেন, মোশতাকের সঙ্গে সেলিমের আঁতাত ছিল। এ বিতর্কও অবশ্য একেবারে নতুন কিছু নয়। যেমন নতুন নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন থেকেই অভিযোগ করা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়া জড়িত ছিলেন।
কবি আল মাহমুদ তার কবির মুখ গ্রন্থে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিশ্চয়ই একদিন কেউ না কেউ সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করবে। হয়তো শতবর্ষ পরে। তখন আজকের প্রগতিশীলরা থাকবেন না। প্রতিক্রিয়াশীল বলেও কেউ হয়তো আর থাকবেন না। শুধু থাকবে ইতিহাসের কঠোর বাস্তবতার বলিরেখাযুক্ত মুখায়ব।
বাংলাদেশে হয়তো সে ইতিহাস লিপিবদ্ধ হতে শুরু করেছে। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়; অন্যান্য অধ্যায় নিয়েও।

No comments

Powered by Blogger.